জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন নানা নাটকীয়তা ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। দীর্ঘ ৫৮ ঘণ্টা পর শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। এতে বড় জয় পেয়েছে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’, তারা জিএস ও এজিএসসহ মোট ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতেই বিজয়ী হয়েছে।
এদিকে, ভিপি পদে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতু ৩ হাজার ৩৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। জিএস পদে ৩ হাজার ৯৩০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’-এর প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম।
এছাড়া বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দুটি করে পদে জয় পেয়েছেন। তবে কোনো পদেই জয় পায়নি ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীরা।
এদিকে অব্যবস্থাপনা, ভোট বর্জন, পদত্যাগ এবং নির্বাচন কেন্দ্রে শিক্ষিকার মৃত্যুসহ নানা কারণে জাকসু নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ভোটের পাঁচ দিন আগে বামসমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থীর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ, ছাত্রদলের বিদ্রোহী প্রার্থীর দুই দিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে আগের থেকেই সংশয় ছিল। এই আলোচনা-সমালোচনা এবং নিষিদ্ধের ৩৫ বছর পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতির সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে ছাত্রশিবির।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সিনেট ভবনে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে জাকসুর ফল ঘোষণা শেষ হয়। হল সংসদের ফল ঘোষণা করেন হল সংসদের নির্বাচনের দায়িত্বরত রিটার্নিং কর্মকর্তারা এবং কেন্দ্রীয় সংসদের ফল ঘোষণা করেন জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান এবং নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম রাশিদুল আলম।
ফলাফল ঘোষণার শুরুতে মহান মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ এবং ভোট গণনার কাজে এসে মারা যাওয়া শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি ও অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে নির্বাচন কমিশন।
ফল ঘোষণায় দেরির কারণ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফলাফল প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত ছিল।
দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ডিজিটাল নয়, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ফলাফল ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে। আমরা তাদের দাবিতে সাড়া দিয়েছি। আমাদের সহকর্মী পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে দুদিন ও দুই রাত কষ্ট করে ফলাফল প্রস্তুত করেছেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা দেখছি বিভিন্ন পক্ষ নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশনের কাছে এ ধরনের কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। ৩৩ বছর পর নির্বাচন করতে গিয়ে ছোট ছোট জায়গায় হয়তো কিছুটা বিচ্যুতি হতে পারে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ভুল হয়ে থাকলে সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন সদস্য সচিব।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ৩৩ বছর পর এমন এক বিষয় নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি, যা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অনন্য অসাধারণ বিষয় হয়ে থাকবে। আমরা অনেক চড়াই-উতড়াই, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা একসঙ্গে হতে পেরেছি।
এর আগে দুপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যদি কেউ কারচুপি বা জাল ভোট প্রমাণ করতে পারে, আমি পদত্যাগ করব, এমনকি আমার পেনশনের টাকাও নেব না।
তিনি বলেন, যারা নির্বাচন বর্জন করেছেন, সেটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। কারও ইচ্ছে হলে বর্জন করবেন, আবার কারও ইচ্ছে হলে গ্রহণ করবেন। এটি গণতান্ত্রিক অধিকার।
গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে রাত সোয়া ৮টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি হলে এ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোট গ্রহণ শুরুর সময় কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি কম দেখা গেলেও দুপুরের পর ভোটারদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ভোট গ্রহণের নির্ধারিত সময় বিকেল ৫টার পরও কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের সারি থাকায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল ও তাজউদ্দীন হলে সন্ধ্যার পরও ভোট চলতে থাকে। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলে এ ভোট গ্রহণ।
ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকেই কেন্দ্রগুলোতে নানা অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়। একেক হলে একেক নির্দেশনা পালন, কোথাও ভোটার তালিকায় ছবি না থাকা, আবার কোনো কেন্দ্রে হাতের আঙুলে অমোচনীয় কালি না দেওয়াসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়। এসব বিষয়ে অভিযোগ দিতে থাকেন শিক্ষার্থী ও প্রার্থীরা।
এবারের জাকসু নির্বাচনে ১১ হাজার ৭৪৩ জন নিবন্ধিত ভোটার ছিলেন। এর মধ্যে ৭ হাজার ৯৩৪ জন শিক্ষার্থী নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন। কেন্দ্রীয় ও হল সংসদগুলোতে ৩৪০ পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৬২০ প্রার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি হলের ৩১৫টি পদের মধ্যে ১৩১টিতে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এবং ৬৮টি পদ শূন্য থাকছে। কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি পদের বিপরীতে ১৭৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যার মধ্যে ১৩২ জন ছাত্র ও ৪৫ জন ছাত্রী।
বিজয়ী হলেন যারা
নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের ও তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আবদুর রশিদ জিতু এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচিত হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ও ইংরেজি বিভাগের মাজহারুল ইসলাম।
এ ছাড়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফেরদৌস আল হাসান (২৩৫৮) এবং এজিএস (নারী) পদে দর্শন বিভাগের আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা (৩৪০২) নির্বাচিত হয়েছেন।
অন্য পদে যারা নির্বাচিত হয়েছেন– শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে ফার্মাসি বিভাগের আবু উবায়দা উসামা (২৪২৮), পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সম্পাদক পদে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী সাফায়েত মীর (২৮১১), সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ইংরেজি বিভাগের জাহিদুল ইসলাম বাপ্পী (১৯০৭), সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে শেখ জিসান আহমেদ (২০১৮) ও সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের রায়হান উদ্দিন (১৯৮৬), নাট্য সম্পাদক হিসেবে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের রুহুল ইসলাম (১৯২৯), ক্রীড়া সম্পাদক পদে বাংলা বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের মাহমুদুল হাসান কিরণ (৫৭৭৮), সহক্রীড়া (ছাত্র) পদে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের মাহাদী হাসান (২১০৫) ও সহক্রীড়া (ছাত্রী) পদে গণিত বিভাগের ফারহানা লুবনা (১৯৭৬)।
আইটি ও গ্রন্থাগার পদে ফার্মাসি বিভাগের রাশেদুল ইমন লিখন, সমাজসেবা ও মানবসেবা উন্নয়ন পদে আহসান লাবিব (১৬৯০), সহসমাজসেবা ও মানবসেবা উন্নয়ন পদে মাইক্রোবায়োলজি (ছাত্র) তৌহিদ হাসান (২৪৪২) এবং সহসমাজসেবা ও মানবসেবা উন্নয়ন (ছাত্রী) পদে ফার্মাসি বিভাগের নিগার সুলতানা (২১৬৬)।
স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সম্পাদক পদে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের হুসনী মোবারক (২৬৫৩) এবং পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক পদে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের তানভীর রহমান (২৫৫৯) নির্বাচিত হয়েছেন।
এ ছাড়া কার্যকরী সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন ফাবলিহা জাহান নাজিয়া (২৪৭৫), নাবিলা বিনতে হারুন (২৭৫০), নুসরাত জাহান ইমা (৩০১৪), হাফেজ তরিকুল ইসলাম (১৭৪৬), আবু তালহা (১৮৫৪) ও মোহাম্মদ আলী চিশতী (২৪১৪)।
ভোট গ্রহণ নিয়ে নানা বিতর্ক
জাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগে থেকেই বিতর্ক সঙ্গী হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ভোটার ও প্রার্থী তালিকা নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে বাদ দেওয়া হয় সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায় জনকে। ভোটের দুদিন আগে ছাত্রদলের বিদ্রোহী সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তার সরে যাওয়া নিয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ভোট শুরুর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে (রাত ৪টায়) নির্বাচন কমিশন অনানুষ্ঠানিকভাবে জানায়, প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারবে। কয়েকটি হলে সকাল ৯টায় ভোট গ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও সকাল পৌনে ১০টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। এরপর সাড়ে ১০টার দিকে দেখা দেয় বৈদ্যুতিক গোলযোগ। ফলে অন্ধকারের মধ্যেই মোবাইলের আলো দিয়ে ২৫ মিনিট চলে ভোট গ্রহণ। এসবের কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
এর বাইরে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে মোট ভোটারদের থেকে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রদল-শিবিরসহ কয়েকজন প্রার্থী। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পাঁচ-ছয়টি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের হাতের আঙুলে মার্কার দিয়ে দাগ দেওয়া হয়নি। নারীদের কয়েকটি কেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশেও বাধা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ছাড়া ভোট দেওয়ার পর আঙুলে মার্কার দিয়ে দাগ না দেওয়া এবং ছবিসহ ভোটার তালিকা না থাকার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করলে ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল প্রায় আধা ঘণ্টা। বেলা ১১টার দিকে ছাত্রদলসমর্থিত ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী হাসান ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলে প্রবেশ করলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পরে এক ঘণ্টা ভোট বন্ধ থাকে।
জাতীয় কবি নজরুল হলের হল সংসদ ভোটের ব্যালটে সদস্য পদের তিনটি ভোট দেওয়ার জায়গায় একটি ভোট দেওয়ার তথ্য লেখা হয়। পরে এটি হাতে সংশোধন করা হয়। নির্বাচন শেষের দেড় ঘণ্টা আগে ছাত্রদলের প্যানেল এবং নির্বাচন শেষের দুই ঘণ্টা আগে বামসমর্থিত চারটি প্যানেলের ৬৮ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাদের দাবি ছিল, নির্বাচনের ব্যালট এবং ওএমআর মেশিন জামায়াতসমর্থিত একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনে অব্যবস্থাপনা এবং কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। তবে এই দাবির সঙ্গে একমত হয়নি শিবিরের সমন্বিত শিক্ষার্থী প্যানেল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক জিতুর নেতৃত্বাধীন প্যানেল ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’।
তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের ভোট বর্জনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ছাত্রদলের ভোট বর্জনের পরও ১৯টি হলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণে দীর্ঘ সারি দেখা যায়। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম হলে রাত সোয়া ৮টা এবং শহীদ তাজউদ্দীন হলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। এদিকে ভোট বর্জনের পরে পাঁচটি প্যানেলের প্রার্থীদের ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।
বারবার পেছায় ফল প্রকাশের সময়
জাকসু নির্বাচনে ১১ হাজার ৭৪৩ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়েছে ৮ হাজার ৩টি, ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। নিয়ম অনুসারে ভোট প্রদান শেষ হলে দ্রুততম সময়ে তা গণনা করে ফল প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভোট গণনায় দেরি হওয়ায় ফল প্রকাশের সময়ও বারবার পেছাতে থাকে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে শুক্রবার সকালে প্রীতিলতা হলের পোলিং অফিসার জান্নাতুল ফেরদৌস নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে মৃত্যুবরণ করলে পুরো ক্যাম্পাসে শোকের ছায়া নেমে আসে। এতেও ফল গণনায় ভাটা পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব বৃহস্পতিবার রাতে প্রথমে সাংবাদিকদের জানান, শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ভোট গণনা শেষ হতে পারে। পরে শুক্রবার দুপুরে তিনি আবার জানান, গণনা শেষ হতে রাত ৮-১০টা বাজতে পারে। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, রাতের মধ্যেই জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদ ও ২১টি হল সংসদের ভোট গণনা শেষে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে।
শনিবার দুপুর ১২টা এবং পরে দুপুর ২টার সময় ফল ঘোষণা করা হবে বলে জানালেও ভোট গ্রহণ শেষে ৪৭ ঘণ্টা পরে সিনেট ভবনে ফল ঘোষণা শুরু করে নির্বাচন কমিশন। তবে শিক্ষক, ছাত্র সংসদের প্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের দাবি, জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের গ্রুপিং, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র এবং ক্যাম্পাসে ভিসিবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধাতেও ভোটে অব্যবস্থাপনা ও গণনার সময়ক্ষেপণ করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের দুই সদস্যের পদত্যাগ
জাকসু নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও দলীয় প্রভাবের অভিযোগ তুলে বিএনপি সমর্থিত তিন শিক্ষক দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন। তারা হলেন– অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা ও অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম খান। তাদের মধ্যে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক, বাকি দুজনই নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী আদর্শের শিক্ষক হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
অধ্যাপক নজরুলকে নির্বাচনের সার্বিক পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং বাকি দুজন বিভিন্ন হলে ভোট পর্যবেক্ষণ করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে ভোট গ্রহণ শেষের আধাঘণ্টা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন প্রশাসনিক ভবনে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক নজরুল নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন।
শুক্রবার কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা শুরুর দুই ঘণ্টা পর রাত ৯টায় নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন নির্বাচন কমিশনার ও জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি মাফরুহী সাত্তার। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনের সদস্য ড. তানভীর এলাহী বলেন, পদত্যাগের বিষয়ে শুনেছি; কিন্তু লিখিত পদত্যাগপত্র পাইনি।
শনিবার দুপুরে নির্বাচন কমিশনের আরেকজন সদস্য ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা পদত্যাগ করার তথ্য সাংবাদিকদের জানান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিনিধি ও সহযোগী অধ্যাপক। তবে তিনি গণমাধ্যমকে কোনো কারণ উল্লেখ করেননি।
‘শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আমাদের মেনে নিতে হবে’
জাকসু নির্বাচনে প্রকাশ্য অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ থাকলেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এই রায় মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শাখা ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের নারী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী আঞ্জুমান ইকরা, সহ-ক্রীড়া সম্পাদক রুহুল আমীন সুইট এবং কার্যকরী সদস্য পদপ্রার্থী হামিদুল্লাহ সালমান। শুক্রবার বিকেলে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক পোস্টে ইকরা এ কথা জানান। এর আগে দুপুরে একইভাবে ফেসবুকে জানান রুহুল আমীন সুইট ও সালমান।
বিজয়ী ভিপি-জিএসের প্রতিক্রিয়া
জয়ের পর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে শিবিরের নবনির্বাচিত জিএস মাজহারুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের যে নিরঙ্কুশ বিজয়, এ বিজয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর। আমরা তখনই বিজয় অর্জন করব, যেদিন আমরা আমাদের জাকসু থেকে দায়িত্ব পালন শেষ করে পরবর্তী জাকসু অনুষ্ঠিত করতে পারব। এই ক্যাম্পাসের হাজার হাজার শিক্ষার্থী যারা আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, তাদের আমানতের ভার আমরা রক্ষা করতে পেরেছি, সেই দিন আমরা বলতে পারব আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের ভিপি আব্দুর রশিদ জিতু প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ৩৩ বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে জাকসু নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেছে। যদিও নির্বাচনে কিছু অব্যবস্থাপনা বা কিছু সাময়িক ত্রুটি ছিল। নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তবে আমরা যেহেতু সবাই শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি, তাই দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে সবাই একসঙ্গে কাজ করব। নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আগামী এক বছর সেগুলো বাস্তবায়ন করব।
আমারবাঙলা/এফএইচ