ফিচার

শহীদ আবু সাঈদ ছিল আশার আলো — নতুন ঘরে নেই শান্তি, কেবল হাহাকার

বিশেষ প্রতিবেদক

বছর দেড়েক আগেও তিনি ছিলেন শুধুই এক মেধাবী ছাত্র, সতীর্থ আর আন্দোলনের সহযাত্রীদের কাছে পরিচিত। আজ সেই আবু সাঈদ রংপুরের প্রত্যন্ত বাবনপুর গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এক প্রতীকের নাম—জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ। দেয়ালে দেয়ালে, সভা-সেমিনারে, পোস্টারে তাঁর মুখ; আর মায়ের চোখে জল।

রংপুর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়া ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামে শহীদ আবু সাঈদের বাড়ি। গ্রামের প্রবেশপথে এখন ইট-বালির কাজ চলছে। সামনে পিচ ঢালার প্রস্তুতি চলছে—জানালেন পাশের এক নির্মাণকর্মী।

সরু পথ ধরে কিছুদূর এগোলে চোখে পড়ে নতুন একটি ইটের ঘর—চকচকে গোলাপি রঙের দেয়াল, চওড়া বারান্দা। ঠিক সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মনোয়ারা বেগম, শহীদ আবু সাঈদের মা। মাথায় গামছা, ভেজা চুলে রোদ লেগে মুখটা উজ্জ্বল হলেও চোখের কোণে লেগে আছে অশ্রু।
ধীরে ধীরে বললেন, “নতুন ঘর হয়েছে ঠিকই, সবাই আছে… কিন্তু আমার সাঈদ তো নেই। বুক খালি করে চলে গেছে। এই শূন্য বুকের হাহাকার কি আর থামে?”

মায়ের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।
“সংসারটা ছিল খুব অভাবের। ও ছোট থেকেই খুব ভালো ছাত্র ছিল। কোনোদিন এক টাকাও হাতে দিতে পারিনি। নিজের খরচ নিজেই চালাতো। পড়াশোনার শেষদিকে ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। সে হাসত, বলত, ‘নিজের থাকার জায়গা নেই মা, বউকে রাখব কোথায়”?

আবু সাঈদের বাবা, কৃষক মকবুল হোসেন, অনেক আগে থেকেই ঘরের জন্য ভিত দিয়েছিলেন। কিন্তু অভাবের সংসারে সেই ঘর আর ওঠেনি।
গত বছরের ১৬ জুলাই, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় পুলিশ গুলিতে প্রাণ হারান আবু সাঈদ। শহীদ হওয়ার পর বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তায় উঠেছে নতুন এই ঘর। কিন্তু সেই ঘরের পেছনেই মাটির নিচে চিরঘুমে শুয়ে আছেন আবু সাঈদ।

তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ। ১৬ জুলাই ২০২৫, তাঁর প্রথম শাহাদতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাইফুল ইসলাম।

গত বছরের ১৬ জুলাই, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র, মাত্র ২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ।
তিনি ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন অন্যতম সমন্বয়ক।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়—আন্দোলনের সময় দুই হাত প্রসারিত করে, বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। পুলিশের খুব কাছ থেকে ছোড়া গুলি লাগে সেই বুকেই। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

সেই প্রতিরোধের মুহূর্ত—দুই হাত ছড়িয়ে বুক পেতে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি আজও আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে। সাহসের অনুপ্রেরণা।

আজ দেশের শাসনব্যবস্থা পাল্টে গেছে। স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে। তবু, সহজ-সরল মনোয়ারা বেগম আজও বিশ্বাস করতে পারেন না—তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ছেলেটা আর কোনোদিন বাড়ি ফিরবে না।

“কবে, কীভাবে ওর বুকের মধ্যে এত সাহস জমেছিল, আমি তো জানতামই না”, বলেন তিনি।
আরও বলেন, “আন্দোলনের খবর যদি জানতাম… ওকে ফোন করে বলতাম, ‘বাড়ি আয় বাবা’। তাহলে হয়তো ও বেঁচে থাকত”।

তিনদিন আগে ছেলের সঙ্গে শেষবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন মনোয়ারা বেগম। কথা হয়নি, শুধু একটা কল এসেছিল—কী বলেছিল, তাও আর শোনা হয়নি।

বাড়ির পুরোনো মাটির ঘরের বারান্দায় বসে কথা হচ্ছিল সন্তানের শোকে বিভোর এই বাবা-মায়ের সঙ্গে।
আবু সাঈদের বাবা বললেন, “সরকার বলেছিল, জুলাই শহীদদের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেবে। আজও সেই টাকার কোনো খবর নেই”।
মনোয়ারা বেগম বলেন, “অন্যান্য জায়গা থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছি বলেই নতুন ঘরটা উঠেছে। জমি বর্গা রাখা হয়েছে ছেলেরা। কিছু সচ্ছলতাও এসেছে”।

সাঈদের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “ও ছিল আমার ছোট ছেলে। কিন্তু কোনোদিন চোখে চোখে রাখতে হয়নি। কখনো কোনো অভিযোগ ছিল না। শান্ত, মেধাবী, দায়িত্ববান ছেলে ছিল। সবচেয়ে ছোট হয়েও সাঈদই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় আশার আলো”।

সাঈদের স্মৃতি আজও তাদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় টিউশন করে নিজের খরচ চালাতেন। নিজের খরচ ছাড়াও মায়ের চিকিৎসা, ছোটবোনের খরচ—সবই সামলাতেন।

মাঝেমধ্যে বাড়ি এলেই পাশের বাড়িতে বিয়ে হওয়া বোন সুমিকে ডাকতেন রান্নার জন্য। গভীর রাতে পড়াশোনা শেষে এক কাপ লাল চা খেলেই খুশি থাকতেন সাঈদ। বাজার করতেন, সবাই মিলে খেতেন।

মা বলেন, “ওর মতো সন্তান ক’জনের হয়? রায়হানকে নিয়ে চিন্তা করতাম, সাঈদকে নয়। কিন্তু বন্দুকের সামনে সাঈদ বুক পেতে দেবে—এটা তো ভাবতেই পারিনি”।

বর্তমানে বড় ছেলে রায়হানকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজ ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। এখন ঘরে মানুষ অনেক, সংসারে একটু স্বচ্ছলতাও এসেছে। তবু সাঈদের শূন্যতা পূরণ হয় না।

“সাঈদের বয়সী কাউকে দেখলেই মনে হয়—এটা যদি আমার সাঈদ হতো”, বলেই চোখের জল মুছেন মনোয়ারা বেগম।

সেদিনের স্মৃতি মনে করে বলেন, “পাশের বাড়ির একজন এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সাঈদের কিছু হয়েছে। পরে শুনলাম গুলি লেগেছে। লাশ এলো। আমি শুধু মুখটা দেখলাম। শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছিল আমার সাঈদ”।

বাড়ির সীমানা প্রাচীরের পাশেই সাঈদের কবর। সেই কবরের পাশে গাছ লাগানো হয়েছে।
মনোয়ারা বেগম বলেন, “শুনেছি, গাছ সবসময় আল্লাহর জিকির করে। ওপারে যেন ভালো থাকে আমার বুকের ধন শহীদ আবু সাঈদ”।

সেই কথায় যেন প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে থাকে।
মকবুল হোসেন বলেন, “সন্তানের হাতে মা-বাবার কবর হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা আজ সন্তানের কবর পাহারা দিচ্ছি”।

আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

FACD-CAB নির্বাচনে প্রার্থী হলেন ফাহিম

আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম পরিচিত মুখ মফিজ...

ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান আর নেই

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্যের স্রষ্টা হামিদুজ্জামান খান আর নেই। রবিবার (২০ জু...

কীভাবে আসত ‘ডার্টি মানি’

‘সুলতান অব সুইং’ ওয়াসিম আকরাম ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা র...

নির্বাচন হবেই, দায়িত্ব কে পাবে সেটা পরের কথা : মির্জা ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গতকালও বলেছি আজকেও বল...

কারফিউ শেষে গোপালগঞ্জে চলছে ১৪৪ ধারা

কারফিউ শেষে গোপালগঞ্জ জেলাব্যাপী শুরু হয়েছে ১৪৪ ধারা। পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থ...

FACD-CAB নির্বাচনে প্রার্থী হলেন ফাহিম

আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম পরিচিত মুখ মফিজ...

কীভাবে আসত ‘ডার্টি মানি’

‘সুলতান অব সুইং’ ওয়াসিম আকরাম ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা র...

নিঃসঙ্গ পাহাড়ে রোশনি খুঁজে ফেরে ভাই আলীকে...

পাহাড়ে বেড়ে ওঠা দুই ভাই-বোন আলী ও রোশনি একে অপরের পরিপূরক। বাক্‌প্রতিবন্...

কারফিউ শেষে গোপালগঞ্জে চলছে ১৪৪ ধারা

কারফিউ শেষে গোপালগঞ্জ জেলাব্যাপী শুরু হয়েছে ১৪৪ ধারা। পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থ...

ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান আর নেই

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্যের স্রষ্টা হামিদুজ্জামান খান আর নেই। রবিবার (২০ জু...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা