অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য দেশি-বিদেশি চক্রের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিকল্পিত অপপ্রচার এবং এআই-সৃষ্ট ছবি-ভিডিও ছড়ানোর বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বুধবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রস্তুতি সংক্রান্ত এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে এই মন্তব্য করেন।
প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, যেকোনো অপপ্রচারের সূচনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা দ্রুত ঠেকিয়ে দিতে হবে, যেন এটি ছড়িয়ে পড়তে না পারে। তিনি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ভেতর ও বাইরে থেকে 'বড় শক্তি' এই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে এবং যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ আসতে পারে। তিনি বলেন, "যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক আমাদের সেটা অতিক্রম করতেই হবে।"
একটি সুন্দর ও উৎসবমুখর নির্বাচন নিশ্চিত করতে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ড. ইউনূস বলেন, নির্বাচনী নীতিমালা, ভোটকেন্দ্রের নিয়ম, কীভাবে ভোট দিতে হবে এবং কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে করণীয় কী—এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে।
এই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে অপপ্রচার মোকাবিলা ও জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে তিনি মনে করেন।
উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি বিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ, আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, মুখ্য সচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া, নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গণি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ, পিএসও লে. জে. কামরুল হাসান, পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, র্যাবের ডিজি এ কে এম শহিদুর রহমান, কোস্টগার্ড ডিজি রিয়ার অ্যাডমিরাল জিয়াউল হক, আনসার ডিজি মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদসহ অনেকে।
বৈঠকের বিষয়ে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রথমে মাঠ প্রশাসনের পদায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। ১ নভেম্বর থেকে মাঠ প্রশাসন গোছানোর কাজ শুরু হবে। মাঠ প্রশাসনে যেন এমন পদায়ন না হয় যারা গত তিনটি নির্বাচনে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখানে তারা রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার বা অ্যাসিস্টেন্ট রিটার্নিং অফিসার হিসেবে থাকুন না কেন, গত তিন নির্বাচনে তাদের যদি ন্যূনতম ভূমিকা থাকে তাহলে যেন পদায়ন না হয় -এ বিষয়ে বলা হয়েছে।’
প্রেস সচিব বলেন, ‘ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এরই মধ্যে পদায়নের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পদায়নের ক্ষেত্রে কী কী ক্রাইটেরিয়া হবে এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যিনি সবচেয়ে বেশি ফিট তার ক্রাইটেরিয়ায় আগের পোস্টিং, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড, কর্মদক্ষতা, তার বিরুদ্ধে কোনো নিউজ আছে কিনা অনেকগুলো বিষয় দেখা হচ্ছে। কতটুকু ফিট এবং যিনি ফিট তাকে দেওয়া হবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়। এগুলো র্যান্ডামলি নির্বাচন করা হবে।’
শফিকুল আলম বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমাদের সেরাটা আশা করতে হবে কিন্তু সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ যেকোনো পরিস্থিতির জন্য যেন প্রস্তুত থাকি আমরা। পদায়নের ক্ষেত্রে নিজ জেলায় কেউ যাবেন না। বিশেষ করে, আত্মীয় কিংবা শ্বশুরবাড়ি যদি থাকে সেখানে পোস্টিং হবে না। আরেকটি বিষয় দেখা হবে, পদায়নের ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয় কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে কিনা। আর এ বিষয়ে যে কাজ সেটি ১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে।’
প্রেস সচিব জানান, সামাজিক মাধ্যম নিয়ে আজ অনেক আলাপ হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে কীভাবে ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে, সেটা নিয়ে আজকের মিটিংয়ে বড় রকমের আলাপ হয়। এ জন্য দুটি কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। একটা হলো, সেন্ট্রাল সমন্বয় কমিটি, একদম উপজেলা পর্যন্ত এই কমিটি যেন থাকে। সেই বিষয়ে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আরেকটা অপতথ্যের জন্য একটা কমিটি করা হচ্ছে। ইসি এবং মন্ত্রণালয়গুলোতেও এই কমিটি থাকবে। এটা উপজেলা পর্যায়েও থাকবে, যাতে সঙ্গে সঙ্গে রেস্পন্স করা যায়।
শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলতে পারবেন। আর আজকের (বুধবার) সাক্ষাৎকার (রয়টার্স) আমরা আগে পড়ি, তারপর এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব। একটা বিষয়ে আমরা বারবার বলছি এটা জাতিসংঘের রিপোর্টেও প্রমাণিত যে, এই একবিংশ শতাব্দীতে ওনার (শেখ হাসিনা) চেয়ে বড় খুনি বা মানবাধিকার লঙ্ঘন, এরকম ভয়ানকভাবে কেউ করেননি।’
তিনি বলেন, ‘এটা আমরা বারবার বলছি এবং এটা জাতিসংঘের রিপোর্টেও স্পষ্টভাবে এসেছে। পরবর্তীকালে আল জাজিরা তাদের একঘণ্টার একটা প্রোগ্রাম করেছে, সেখানে দেখা গেছে যে উনি খুন করার নির্দেশ দিচ্ছেন। যারা ওনাকে ইন্টারভিউ করছেন, আমরা মনে করি, অবশ্যই এই কনটেক্সট (পটভূমি) যেন কেউ ভুলে না যান। আমরা এটা দেখছি, উনি যেই দাবিগুলো করেন, সেটা যেন আনকনটেক্সট না থাকে। গত মঙ্গলবার একটা স্থানীয় মিডিয়ায় দেখলাম, আন্তর্জাতিক আদালতে তার দল একটা অভিযোগ দায়ের করেছে। সেখানে তিনি যে ভয়ানক রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তার কোনো উল্লেখ আমরা সেখানে দেখি নাই। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছে। দেশে বসে অনেকে অনেক ধরনের নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে, আমরা এটা স্পষ্ট দেখছি। প্রধান উপদেষ্টা সেই বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। কেননা, পতিত স্বৈরাচার এবং তার দোসররা অবশ্যই চাইবে না যে, দেশে একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক।’
প্রতি জেলায় এক কোম্পানি সেনা মোতায়েন ॥ প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন নিয়ে আলাপ হয়েছে। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হয়েছে, ৯২ হাজার ৫০০ জন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। তার মধ্যে ৯০ হাজার সেনা সদস্য, বাকিটা নৌবাহিনী। সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রত্যেক উপজেলায় এক কোম্পানি করে মোতায়েন থাকবে। এছাড়া নির্বাচনের ৭২ ঘণ্টা আগে এবং নির্বাচনের পরে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্থানীয় জনগণ, স্বেচ্ছাসেবক সম্পৃক্ত করে কীভাবে সামলানো যায় সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে।
আমারবাঙলা/এফএইচ