যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটান তিনি। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় (গ্রিনিচ মান সময় ১৭.০০ ও বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা) শপথ গ্রহণ করেন বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্ট।
চার বছর আগে ক্ষমতা না ছাড়তে চাইলেও হোয়াইট হাউস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ট্রাম্প। চার বছর পর দেশের মানুষের বিপুল সমর্থন নিয়ে সেই হোয়াইট হাউসেই ফিরলেন এ ধনকুবের। ২০২০ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের কাছে পরাজয়ের পর পৌঁছে গিয়েছিলেন খাদের কিনারে; সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, আততায়ীর বুলেট এড়িয়ে, অধিকাংশ মার্কিন ভোটারের সমর্থন নিয়ে ৫ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রিপাবলিকান ট্রাম্প। ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আগে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।
ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস ভবনের ভেতরে ক্যাপিটল রোটুন্ডায় ট্রাম্প শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের কয়েক মিনিট আগে তিনি অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন। ট্রাম্পের আগে শপথ নেন ভাইস–প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স।
ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন উপস্থিত ছিলেন। ট্রাম্প অনুষ্ঠানস্থলে আসার আগে সেখানে উপস্থিত হন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। উপস্থিত ছিলেন ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প, ছোট ছেলে ব্যারন ট্রাম্প, টিফানি ট্রাম্প, লারা ট্রাম্প, এরিক ট্রাম্প, জ্যারেড কুশনার, ইভাঙ্কা ট্রাম্প এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র। শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস। ডেমোক্র্যাট হ্যারিসকে হারিয়েই ইতিহাস গড়েন ট্রাম্প।
বিদেশি অতিথি হিসেবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইসহ আরো অনেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্পেসএক্স ও টেসলার সিইও ইলন মাস্ক, গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই, মেটার সিইও মার্ক জুকারবার্গ, অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে কমালা হ্যারিসকে পরাজিত করে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন ট্রাম্প। আমেরিকান গণতন্ত্রের প্রায় ২৫০ বছরের ইতিহাসে ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প মাত্র দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি প্রথম মেয়াদের পর পরাজিত হয়ে চার বছর পর আবার জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। এর আগে ১৮৯০-এর দশকে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড চার বছর পর দ্বিতীয় মেয়াদ লাভ করেন। ৮২ বছর বয়সী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক মেয়াদ পরেই বিদায় নিলেন। তিনি ২০২৪ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য এগিয়ে থাকলেও স্বাস্থ্যগত কারণে প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এদিকে ট্রাম্পের শপথ নেওয়াকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন ডিসির নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এ শপথ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় রাজধানীতে দায়িত্ব পালন করেন ন্যাশনাল গার্ডের সাত হাজার ৮০০ সদস্যসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ২৫ হাজার সদস্য।
তীব্র শীতের কারণে ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম অভিষেক মার্কিন ক্যাপিটল ভবনের পশ্চিম দিকের খোলা সিঁড়ির পরিবর্তে গম্বুজঅলা গোলাকার হলঘর রোটান্ডায় অনুষ্ঠিত হয়। চার বছর আগে ট্রাম্পের একদল উগ্র সমর্থক মার্কিন গণতন্ত্রের প্রতীক এই ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালিয়েছিল, তারা ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের কাছে রিপাবলিকান ট্রাম্পের পরাজয় আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন।
শপথ এবং আশীর্বাদের কর্মসূচি
স্থানীয় সময় বেলা ১১.৩০টায় অভিষেক অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স শপথ নেন, শপথবাক্য পাঠ করান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জন কাভানা। তারপর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার অভিষেক ভাষণ দেন, যেখানে তিনি তার প্রশাসনের মূল নীতি, মূল্যবোধ এবং অগ্রাধিকারগুলো তুলে ধরেন। এরপর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সিয়াল প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত এই প্যারেড পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ দিয়ে ক্যাপিটল ভবন থেকে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত যায়। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে এই প্যারেড হয় ক্যাপিটল ওয়ান অ্যারেনার ভেতরে।
অনুষ্ঠানের শেষে আশীর্বাদমূলক বক্তব্য দেন চারজন ধর্মীয় নেতা- ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট র্যাবাই ড. আরি বেরম্যান; কারবালা ইসলামিক এডুকেশন সেন্টারের ইমাম হুসাম আল-হুসেইনি; ডিট্রয়েট-এর ১৮০ চার্চের প্যাস্টর লরেনযো সুওেল এবং ব্রুকলিনের রোমান ক্যাথলিক ডাইওসিস-এর রেভেরেন্ড ফাদার ফ্র্যাঙ্ক মান।
যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ কংগ্রেসের কার্যালয় ক্যাপিটল ভবনের সিঁড়িতে অনুষ্ঠানের জন্য প্রায় আড়াই লাখ টিকিট ট্রাম্পের সমর্থক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু, ট্রাম্পের অনুরোধে অভিষেক অনুষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে নেওয়ার ফলে মাত্র ৬০০ জনের মতো মানুষ সরাসরি ট্রাম্পকে শপথ নিতে দেখেন। আবহাওয়ার কারণে পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ দিয়ে ক্যাপিটল থেকে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী প্যারেড বা পদযাত্রাও বাতিল করা হয়। বিভিন্ন ব্যান্ড পার্টি, মার্চিং দল ইত্যাদি ২০ হাজার আসনবিশিষ্ট ক্যাপিটল অ্যারেনায় ট্রাম্প, তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প এবং তার নতুন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে দিয়ে প্যারেড করে যায়। শপথ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন ক্যারি আন্ডারউড এবং লি গ্রিনউডের মতো জনপ্রিয় শিল্পীরা। এ ছাড়া ‘ওয়াইএমসিএ.’ গানে পারফর্ম করেন ভিলেজ পিপল। গান করেন কিড রক এবং বিলি রে সাইরাসও।
দুই শতাধিক নির্বাহী আদেশ দিয়ে প্রথম দিন শুরু
ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে দায়িত্ব গ্রহণের পরই ২০০টি’র বেশি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এর মধ্যে ছিল আইনত বাধ্যতামূলক আদেশ এবং প্রেসিডেন্টের অন্যান্য নির্দেশাবলী। আবার অনেক আদেশেই বাতিল হবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের গৃহীত নীতি।
নির্বাহী আদেশ হচ্ছে ফেডারেল সরকারকে দেওয়া প্রেসিডেন্টের লিখিত আদেশ, যে আদেশ বাস্তবায়নে কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ, এই আদেশবলে একজন প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টে আইনপ্রণেতাদের ভোটাভুটি ছাড়াই নীতি পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। তবে এই আদেশ আইনের আওতার মধ্যে থেকেই বাস্তবায়িত হতে হয় এবং কখনো কখনো এ আদেশগুলোর কিছু আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে পারে। বিশেষ করে অভিবাসনের মতো নীতিগুলোর ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে। রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্সির ক্ষমতাবলে গণহারে অভিবাসী বিতাড়ন, পরিবেশসংক্রান্ত বিধিনিষেধ কমানো এবং আরো বহু বিষয়ে একতরফাভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেগুলো পূরণ করতেই একগুচ্ছ নির্বাহী আদেশ সইয়ের এই পদক্ষেপ নিলেন তিনি। শপথ নেওয়ার আগের দিন বিজয় সমাবেশে ট্রাম্প তার সমর্থকদের জানান, তিনি শপথ গ্রহণের পর ঐতিহাসিক গতি ও শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করবেন।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প সই করেছিলেন ২২০টি নির্বাহী আদেশ। এর মধ্যে কয়েকটি আদেশ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। আর বাইডেন যখন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখন তিনি সই করেছিলেন ১৬০টি নির্বাহী আদেশ। আর এর আগে বারাক ওবামা এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে সই করেছিলেন যথাক্রমে ২৭৭ এবং ২৯১টি নির্বাহী আদেশ।
এদিকে শপথ নেওয়ার জন্য ট্রাম্প, তার স্ত্রী মেলানিয়া এবং ট্রাম্প পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ইউএস এয়ার ফোর্সের একটি উড়োজাহাজ স্থানীয় সময় শনিবার ডালাস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। সেখান থেকে ট্রাম্প পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ওয়াশিংটন উপকণ্ঠে অবস্থিত ভার্জিনিয়ায় তার গলফ ক্লাবে যান। গলফ ক্লাবে আতশবাজি পোড়ানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ট্রাম্পের শপথগ্রহণ উৎসব।
আমারবাঙলা/এমআরইউ
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            