জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে নেমে সরকার পতনের মাধ্যমে ঐক্যের বার্তা দিয়েছিলেন। ঐকমত্যের পথেই হাঁটছিলেন তারা। সম্প্রতি রাজনৈতিক নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে সেই ঐক্য এখন বিভেদে পরিণত। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দূরত্ব গত কয়েক দিনে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
যদিও এনসিপি নেতারা বলছেন, বিগত সময়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় সেভাবে সমালোচনা করার সুযোগ ছিল না। অভ্যুত্থান পরবর্তীসময়ে সেই সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে আপাতদৃষ্টিতে দূরত্ব মনে হলেও সেটি দূরত্ব নয়। তবুও কেউ কেউ এটাকেই দূরত্ব বলছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের দায়িত্ব নেওয়া-না নেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এতে দুই দলের নেতারাই পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করতে থাকেন। ইশরাকের অনুসারীরা ঢাকাবাসীকে নিয়ে টানা কয়েকদিন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন। এরপর এনসিপি নেতাকর্মীরা অনেকটা পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট উল্লেখ করে কমিশন বাতিল ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে ইসি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে দলটি। এতে দূরত্ব আরো স্পষ্ট হয়।
শনিবার (২৪ মে) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে বিএনপি সরকারে থাকা দুজন ছাত্র উপদেষ্টার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই দুজন উপদেষ্টা সরাসরি এনসিপির পদে না থাকলেও তারা ভবিষ্যতে এনসিপি থেকেই নির্বাচন করবেন বলে চর্চা আছে। বিএনপির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের পাল্টা বক্তব্যও কিছুটা প্রমাণ করে এই দুই নেতা তাদের লোক।
বিএনপি লিখিত বক্তব্যে বলে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। দেশের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে যেন দেশে অস্থিতিশীল কোনো পরিবেশ সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত কেবল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার কর্তৃক জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হওয়াই সমীচীন।
অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বোঝে; উপদেষ্টা পরিষদে তাদের উপস্থিতি সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতি ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে বলেই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদের অব্যাহতি প্রদান করা প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এরই মধ্যে বিতর্কিত হয়েছেন, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি দিতে হবে।’
উপদেষ্টাদের পদত্যাগ প্রসঙ্গে দলটির নেতা নাহিদ ইসলাম জানান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে নাম জড়িয়ে ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ করতে বলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। তিনি বলেন, ছাত্র উপদেষ্টারা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে গেছেন এবং গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ ১৫ বছর আন্দোলন করেনি। বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে ক্ষমতার পরিবর্তন কিংবা দেশের সুশাসন কিংবা গণতন্ত্র ফিরে আসার সম্পর্ক নেই। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং বিরাজমান যে সংকট এটা নিরসনের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে হতে হবে।’
দলগুলোর মধ্যে দূরত্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব আমি এটাকে দূরত্ব মনে করি না। বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। বিএনপি ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির চিন্তা করে কথা বলেন না।’
নীরব দর্শক জামায়াত?
গত ১২ মে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনসিপি জানায়, যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করে জাতীয় সমঝোতা ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নে সহযোগী হবে।
মূলত মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে জামায়াতের অবস্থানকে কেন্দ্র করে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব তৈরির বিষয়টি সামনে আসে। এছাড়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গেও বেশ দূরত্ব তৈরি হয় এনসিপির। প্রকাশ্যে দুই পক্ষের নেতারাই রাজনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিতে থাকেন।
দুদিন আগে ছাত্রশিবিরের প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম ফেসবুক পোস্টে লেখেন, জুলাইয়ের গাদ্দারদের আহ্বানে নয়, বরং নিজ নিজ তাগিদে দেশের স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াত কিছুটা কৌশলী ভূমিকা পালন করছে। সরাসরি রাজনৈতিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে দেখা গেছে দলটির নেতাকর্মীদের।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট হুমায়রা নূর বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভাজন এমন কোনো পক্ষের সৃষ্টি যারা এনসিপির ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইছে। আমরা জুলাইয়ের চেতনা ধারণ করি, যে চেতনা একাত্তরকেও ধারণ করে। স্পেসিফিক কোনো দলের নামে আমরা কখনো নেগেটিভ বক্তব্য দেইনি। একাত্তরের বিষয়ে রাজনৈতিক দলের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীসময়ে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলের রাজনীতি যেন আর না হয় সেটিই এনসিপির চাওয়া। আমাদের চাওয়াগুলো যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। এই দাবিগুলোর সঙ্গে কোনো দলের মতপার্থক্য দেখালে এনসিপির সঙ্গে বিভাজন মনে করছেন। কিন্তু আমরা মনে করি নতুন বন্দোবস্ত।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে কি না জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘রাজনৈতিক দূরত্ব নয়। রাজনীতিতে সব সময় সমালোচনা-পাল্টা সমালোচনা থাকবে। আগে আওয়ামী লীগ অন্য কোনো দলকে স্পেস দিতো না। এখন একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের উন্নতি হয়েছে। সবাই রাজনীতি করছে, সবাই সবার পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা করছে, প্রতিযোগিতাও আছে। এটা ভালো, কিন্তু এটাকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘রাজনৈতিক দূরত্বনির্ভর করে নির্বাচনসহ দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দলগুলোর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, বিএনপি কন্টিনিউয়াসলি তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার দিকে এগোচ্ছে। ইশরাক হোসেনের মামলা কেন্দ্র করে তাদের যে বক্তব্য, কটাক্ষ এবং ছাত্র উপদেষ্টাদের একচ্ছত্রভাবে অ্যাটাক করার প্রবণতা দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রশাসনে বিএনপির ক্ষমতা কতটুকু আছে।’
তিনি বলেন, ‘এর চেয়েও বেশি ক্ষমতা তারা অর্জন করতে চাইছে। তারা এই পরিমাণ যদি পাওয়ার হাংরি হয়ে ওঠে এখনই, সেটা তো খুবই ভয়ঙ্কর। বলাই বাহুল্য নির্বাচনের পরে তারা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে কী ধরনের জুলুম তারা চালাতে পারে এটার একটা নিদর্শন তারা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে। সেই জায়গা থেকে যদি বলেন বিএনপির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তাহলে দূরত্ব।’
আমারবাঙলা/ইউকে
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            