গত ১৩ জুন শুক্রবার লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক বৈঠকের চূড়ান্ত সাফল্যের পর আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। একদিকে হতাশা এবং অন্যদিকে আতঙ্কের ফলে ভারতে শেল্টার নেওয়া আওয়ামী লীগ এবং তার মেন্টর ভারত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। ওইদিকে তাদের মধ্যেই একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে, (বাংলাদেশের কেউ এ খবর ছড়ায়নি) গত ১৬ জুন থেকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের রাঘববোয়ালদের বিচার শুরু হচ্ছে। সুতরাং, এ বিচার বানচাল এবং ইউনূস-তারেক সৌহার্দকে বিনষ্ট করার জন্য ভারতের অঙ্গুলি হেলনে এবং শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য তারা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।
এ কর্মসূচির অংশ হিসাবে গত ১৬ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটির কাছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা একটি ক্রুড বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ক্রুড বোমা হলো সেই ধরনের বোমা, যেটি টাইম বোমা হতে পারে অথবা রিমোট কন্ট্রোল পরিচালিত বোমা হতে পারে। শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর বলেন, বিস্ফোরণটি ঘটেছিল অতি প্রত্যুষে ৫টা ২৫ মিনিটে। বিস্ফোরিত বোমাটির পাশে একই ধরনের আরেকটি বোমা ছিল। সম্ভবত কোনো টেকনিক্যাল কারণে সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন মেডিকেল সেন্টারের কাছে আরও সাতটি তাজা বোমা পাওয়া যায়। সেগুলো সংশ্লিষ্ট বোমা বিশেষজ্ঞরা অকার্যকর করে দেয়। গত ১ জুন, যেদিন শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজি আবদুল্লাহ আল মামুনসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে চার্জশিট দাখিল করা হয় এবং যেটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়, সেই দিন ট্রাইব্যুনালের সামনে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
একই দিন অর্থাৎ ১৬ জুন অতি প্রত্যুষে, আনুমানিক সূর্যোদয়ের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ব্যানারে ১৫ থেকে ১৮ যুবক একটি ঝটিকা মিছিল করে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক, একই দিন অর্থাৎ সোমবার ১৬ জুন ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ মুজিবুর রহমান হলসংলগ্ন পরীবাগ এলাকায় ছাত্রলীগ নামধারী কতিপয় যুবক একটি ঝটিকা মিছিল করে। মিছিল শেষে কাঁটাবন রোডে তারা দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। বিস্ফোরণ ঘটিয়েই তারা পালিয়ে যায়। পালানোর সময় সন্ত্রাসীদের একজন পুলিশের হাতে আটক হয়। একই দিন সকাল ৬টার দিকে মোতাহার হোসেন ভবনের সামনে গাছের তলায় ছয়টি ককটেল দেখতে পান নিরাপত্তা কর্মীরা। পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টোরিয়াল টিম এবং শাহবাগ থানা পুলিশকে বিষয়টি জানায়। সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে ককটেলগুলো উদ্ধার করে। ১৭ জুন একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকে এ মর্মে রিপোর্ট করা হয়, হাইকোর্ট এলাকাতেও নাকি ওইদিন সকালে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল এবং বোমা ছুড়ে মারার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার পর গত ১৮ জুন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এখানে কয়েকটি তথ্য পাঠকদের জানিয়ে রাখা দরকার। যেহেতু আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাই তাদের কার্যক্রম বাংলাদেশের প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয় না। কিন্তু আওয়ামী লীগের তো দরকার পাবলিসিটি, হিউজ পাবলিসিটি। তিলকে তাল করার মতো পাবলিসিটি। আওয়ামী লীগের পক্ষে এ কাজটি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে করছে ভারতীয় অসংখ্য গণমাধ্যম। কয়েক মাস আগে ভারতীয় গণমাধ্যমের মধ্যে রিপাবলিক টিভি নিয়ে বাংলাদেশে কিছু আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশবিষয়ক সংবাদ পাঠ এবং সংবাদ পর্যালোচনায় ময়ূখ চৌধুরী নামক এমন এক ভাঁড়কে আনা হয়, যে কিনা গোপাল ভাঁড়কেও হার মানায়। তার এসব ছ্যাবলামো দেখে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র হলেও একশ্রেণির দর্শক রিপাবলিক টিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
২.
এখন গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের পাবলিসিটি কাজের মুখ্য ভূমিকা পালন করছে ‘দি ওয়াল’ নামের টিভি চ্যানেলটি। শুধু দি ওয়াল নয়, হিন্দুস্থান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে থেকে শুরু করে ‘দি নর্থ ইস্ট’ নামক গণমাধ্যমটিও অনবরত বাংলাদেশবিরোধী, বিশেষ করে ড. ইউনূসবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দি ওয়ালের নির্বাহী সম্পাদক অমল রায় এক সময়কার ‘আকাশ বাণী’ কলকাতার দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ভারি গলায় প্রতিদিন আওয়ামী লীগের লিফলেট পাঠের মতো আজগুবি ও গাঁজাখুরি সংবাদ পাঠ করে যাচ্ছেন। আর ওইদিকে দি নর্থ ইস্টের চন্দন নন্দী প্রায় প্রতিদিন একটি করে বুলশিট ছাড়ছেন। কখনো বাংলাদেশে সেনাবিদ্রোহ এই হয় হয়, এমন খবর ছাড়ছেন। আবার কখনো চিকেন নেক থেকে বাংলাদেশ আক্রমণের হুমকি দিচ্ছেন। তবে আমার ভাবতে অবাক লাগে, অন্তত দুজন বাংলাদেশি মহিলা চন্দন নন্দী এবং দিল্লির গৌতমের ইন্টারভিউ নিয়ে ইউটিউবে ভাইরাল করেছেন। তবে এমন মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহী এবং হিংসাকে উসকে দেওয়া বক্তব্য বাংলাদেশ থেকেই দেওয়া হচ্ছে, নাকি ভারতে বসে এসব অপকর্ম করা হচ্ছে, সেটি এখনো বোধগম্য হচ্ছে না। ভারত যে কীভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উন্মত্ত প্রচারণা চালাচ্ছে এবং কীভাবে যে আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা অরগান হিসাবে কাজ করছে, তার কিঞ্চিৎ নমুনা নিচে দিচ্ছি।
দি ওয়ালে বলা হয়েছে, আগামী ১৬ জুন আওয়ামী লীগ (দিনটি গত হয়ে গেছে) ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, আগামী ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্মবার্ষিকীতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। ১ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দেশজুড়ে সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল করবে। গত ১০ জুন লন্ডনে ড. ইউনূসবিরোধী আওয়ামী লীগের যে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, তার আগাম খবরও পরিবেশন করে এসব নরেন্দ্র মোদিপন্থি ভারতীয় গণমাধ্যম।
ইতঃপূর্বে ভারতের এসব গণমাধ্যম তাদের আক্রমণের টার্গেট করেছিল মাত্র এক ব্যক্তিকে। তিনি হলেন ড. ইউনূস। তখন ড. ইউনূস এবং বিএনপির মধ্যে কিছুটা টানাপোড়েন চলছিল। তখন তারা ভেবেছিল, ড. ইউনূসকে সরাতে পারলেই বাংলাদেশ থেকে ভারতের আপদ (!) বিদায় হয়। এজন্য তখন তাদের স্ট্র্যাটেজি ছিল, বিএনপিকে তোষণ করে তাদের হাত করা। কিন্তু লন্ডন বৈঠক ভারতের তথা আওয়ামী লীগের সব রণকৌশলকে তছনছ করে দেয়। অতিসাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো শেখ হাসিনার একাধিক, ওবায়দুল কাদেরের দুটি সাক্ষাৎকার, বাহাউদ্দিন নাছিমের দুটি, জাহাঙ্গীর কবির নানকের একটি এবং মোহাম্মদ আরাফাতের একটি ইন্টারভিউ প্রচার ও সম্প্রচার করেছিল। প্রতিটি ইন্টারভিউতে বাংলাদেশের জনগণকে পালটা আঘাত করার ব্যর্থ উসকানি দেওয়া হয়।
৩.
কিন্তু ভারতীয়রা ভুলে গিয়েছিল, বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এখন দ্রুত আরোগ্য লাভ করছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার মতো বেগম খালেদা জিয়াও শুরু থেকেই উপলব্ধি করেন, রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের এক নম্বর শত্রু হলো ভারত। এখন যদি ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিএনপি মাঠে নামে, তাহলে তার মোক্ষম সুযোগ গ্রহণ করবে ভারত এবং আওয়ামী লীগ। গত শুক্রবার এ কলামে আমি উল্লেখ করেছি, কীভাবে বিএনপিকে রাজপথে যাওয়া থেকে বিরত রাখেন বেগম জিয়া। শুধু স্ট্যান্ডিং কমিটিকেই নয়, রোববার ৮ জুন বেগম জিয়া তার পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গেও কথা বলেন। একটি অসমর্থিত খবরে প্রকাশ, লন্ডনযাত্রার আগে বেগম জিয়ার সঙ্গে ড. ইউনূসের টেলিফোনে কথা হয়। আসল কথা হলো, ড. ইউনূস এবং তারেক রহমানের মধ্যে যে প্রীতিময় পরিবেশে সৌহার্দপূর্ণ বৈঠক হলো, তার অনুঘটক ছিলেন গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়া।
৪.
ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের সফল বৈঠকের পর ভারতের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এবার তারা সরাসরি তারেক রহমানকে আক্রমণ শুরু করেছে। অতীতে ইউনূসের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের উসকানি দিয়েছে জেনারেল ওয়াকারকে। জেনারেল ওয়াকার ভারতীয় ফাঁদে পা দেননি। গত ১৭ জুন একটি ভারতীয় চ্যানেলে ওবায়দুল কাদেরের দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করা হয়। ওই সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদেরের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এ গাঁজাখুরি খবরটি উৎপাদন করা হয় যে, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব নাকি ছিল পাকিস্তান থেকে আগত লস্করে তৈয়েবার কীর্তি।
এসব কথা হালে পানি না পাওয়ায় তারা জ্যোতিষিদের দুয়ারেও ধরনা দিচ্ছে। কবে শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন, সেই ভবিষ্যৎ অমৃতবাণী গণকদের গণনা থেকে শুনে নিচ্ছে। কেন তারেক রহমান এখনো দেশে আসছেন না, সেই কারণ ব্যাখ্যার জন্য বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত কতিপয় নাস্তিক ব্লগারেরও শরণাপন্ন হয়েছে। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত এসব ব্লগার ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের ছাতার তলে বসে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তারা কী কী বলছে, সে সম্পর্কে আমি ইচ্ছে করেই কোনো সূত্র দিলাম না। এর মধ্যে তারা দুজন বাংলাদেশি এবং ৫/৭ জন তথাকথিত ভাষ্যকার জোগাড় করেছে। এরা তো কোনো ভাষ্য দিচ্ছে না, উদগিরণ করছে তারেক ও বিএনপির বিরুদ্ধে গিবতের বিষ। সেই সঙ্গে ড. ইউনূসের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের অপরাজনীতির একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে তাদের বিশাল নিরাপদ শেল্টার। সেটি হলো ভারত। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত তথা জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের সেই শেল্টার নেই। সেজন্যই তারা গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী জুলুমের স্টিমরোলারে পিষ্ট হয়েছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ শেল্টার অনেক কাজে লেগেছিল। সেদিন বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন কোনো কোনো ভারতীয় সাংবাদিক শেখ হাসিনাকে প্রবাসী সরকার গঠনের উসকানি দিচ্ছেন। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, এই ’২৪, সেই ’৭১ নয়। আজ ভারতীয়রাই বাংলাদেশের জানি দুশমন। সেদিন অর্থাৎ ’৭১-এ গেরিলারা যখন ‘হিট অ্যান্ড রান’ করত, তখন জনগণ তাদের শেল্টার দিত। পরিস্থিতি শান্ত হলে তারা ভারতে ফিরে যেত।
আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। আজ আওয়ামী লীগের কেউ যদি ভারত থেকে এসে নাশকতা করতে চায়, তাহলে জনগণ তাদের পুলিশ বা মিলিটারির হাতে তুলে দেবে। যতদিন আওয়ামী লীগ ভারতের পক্ষপুটে থাকবে, যতদিন তারা ১৫ বছরের জুলুম, নির্যাতন ও লুণ্ঠনের জন্য তওবা না করবে, যতদিন তারা ১৮ কোটি মানুষের কাছে করজোড়ে ক্ষমা না চাইবে, ততদিন বাংলাদেশের মাটিতে তাদের ঠাঁই হবে না।
আমারবাঙলা/জিজি
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            