বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর প্রশাসন কথাটি একটি অসভ্য শব্দ বা গালি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ‘প্রশাসন’ কথাটির সাথে যে ‘শাসন’ শব্দটি যুক্ত রয়েছে তা নির্দেশ করে দুঃশাসনের, বিভেদের, বৈষম্যের, নির্যাতনের, অমানবিকতার সর্বোপরি মালিককে ভৃত্যের আসনের।
আমি কথা বলছিলাম বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস তথা প্রশাসন ক্যাডারের সমসাময়িক অবস্থান ও প্রেক্ষাপটের কথা। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব নিয়ে যে কথাটি প্রচলিত আছে তা মূলতঃ প্রশাসন ক্যাডারকেই ইঙ্গিত করে। আসলে তারা কাকে শাসন করতে চাইছেন? প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য সকল ক্যাডারের কর্মকর্তারা কি তাহলে এতটাই বেয়াড়া যে তাদেরকে শাসনের আওতায় আনতে হবে? নাকি যুগ যুগ ধরে অন্য সকল ক্যাডার কর্মকর্তাদেরকে দাবিয়ে রাখার জন্য প্রশাসন ক্যাডারের জন্ম? অন্যদিকে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা ডিসি বা ডেপুটি কালেক্টরকে এখন জেলা প্রশাসক বলা হচ্ছে অথচ তার দায়িত্ব ছিল রাজস্ব আদায় করা। সেখানে তিনি হয়ে উঠেছেন শাসক বা প্রশাসক।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা তার চাকরির শুরু থেকে চিকিৎসা সেবা, মেডিকেল কলেজের শিক্ষাদান, অধিদফতর ও হাসপাতালের আনুষঙ্গিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুচারুরূপে পালন করে থাকেন। এভাবে তিনি স্বাস্থ্য সেবা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। ফলে তার পক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালনা করা অসম্ভব কিছু নয়। বরঞ্চ স্বাস্থ্য বিভাগকে পরিচালনার জন্য তারাই উপযুক্ত কর্মকর্তা। এখানে শাসন করার কিছু নেই, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করাই এখানকার মুখ্য কাজ।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে প্রশিক্ষিত করার কোন প্রয়োজনই পড়ে না। বরঞ্চ তা হবে সময় ও অর্থের অপচয় মাত্র। প্রশাসন ক্যাডারের কাউকে এখানে যুক্ত করলে স্বাস্থ্য সেবা বাধাগ্রস্থ হওয়ারই কথা। একইভাবে শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা তার কর্মজীবনের শুরু থেকে শিক্ষাদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার কাজের সাথে যুক্ত থাকেন। তিনি শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা অধিদফতর, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সমূহ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কর্মজীবনের বিভিন্ন টায়ারে কাজ করতে করতে তিনি একদিকে দক্ষ শিক্ষক ও অন্যদিকে অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপক হয়ে ওঠেন। ফলে তার পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মত একটি বিভাগ পরিচালনায় অসুবিধা হবার কথা নয়। বরঞ্চ শিক্ষা বিভাগ সম্পর্কে তিনি একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার চাইতে বেশি ওয়াকিবহাল থাকার কথা।
একইভাবে পররাষ্ট্র, পুলিশ, টেলিযোগাযোগ, প্রকৌশল প্রভৃতির ক্ষেত্রে একই রকমের ব্যবস্থাপনার কথা উঠে আসবে। আধুনিককালে সবকিছুই যেখানে বিশেষায়িত হচ্ছে সেখানে যিনি যে কাজের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ, তাকে সে কাজ দেওয়াই উপযুক্ত। তাহলে কর্মের সকল ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব গড়ে উঠবে এবং কর্মের গুণগত ও পরিমাণগত মান বৃদ্ধি পাবে। লাল ফিতার দৌরত্বও হ্রাস পাবে। মোটা দাগে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দ্বারা অন্য সকল ক্যাডার কর্মকর্তারা বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে পদ বা কাজ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পদায়ন না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। একই সময় একই সাথে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাডারে যোগদান করেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা সুযোগ-সুবিধা, কমান্ড কন্ট্রোল সবদিক থেকে উপরে উঠে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদেরকে তার অধীনস্থ করে রাখছেন। এটি এ কারণেই নয় যে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তা মেধায় কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতায় তার চাইতে অনুপযুক্ত। শুধুমাত্র তারা প্রশাসন ক্যাডারের ট্যাগ নিয়ে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদেরকে অধীনস্থ করছে। ফলে সামাজিক ও মানসিকভাবে এ সকল কর্মকর্তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। তারা না পাচ্ছে পদোন্নতি, না পাচ্ছে বেতন গ্রেড। বঞ্চনা নিয়েই শেষ করছে চাকরি জীবন। এমনকি স্ব স্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য উপযোগী করে গড়েও তোলা হয় না বা গড়ে ওঠার সুযোগও প্রদান করা হয় না। এভাবে এক সময় মিথ্যা এলজাম দিয়ে বলা হয় যে তারা মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য অদক্ষ।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফ্যাসিবাদের জন্ম ও এর বিস্তার লাভ করেছে। সিভিল সার্ভিসে যুক্ত কর্মকর্তারা মুখে জনসেবার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে তারা জনগণকে সেবা দেওয়ার মানসিকতা সম্পন্ন নন। তারা সব সময় প্রভুর আসনে বসে থাকতে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন কিংবা লোভী থাকেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য যে সকল প্রশিক্ষকগণকে যুক্ত করা হয় তারাও কমবেশি একই ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত। ফলে প্রশাসন ক্যাডারের যে অন্তর্নিহিত জিনগত সমস্যা তা প্রশাসন ক্যাডারের নতুন এইসব কর্মকর্তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। সদ্য যোগদানকৃত এ সমস্ত প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা পূর্বসূরীদের আচরণগত জীনই ধারণ করেন।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে যেখানে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা রাষ্ট্র অবয়বে কৃমি কিংবা ঘুনের মত গেথে গিয়ে প্রশাসনের সাথে সাথে বিচারের ব্যবস্থাও বহাল রাখছেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এখনো তিনি এজলাসে ওঠেন এবং বিচারও করেন।
জাতি হিসাবে আমরা আসলেই বুঝতেই পারেনি কখন ডেপুটি কালেক্টর রাজস্ব আহরনের কাজ ফেলে জাতির প্রশাসক হয়ে গেলেন! কবি তারাপদ রায় ঠিকই বলেছেন,
“আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে”
লেখক, সম্পাদক, দৈনিক আমার বাঙলা
আমার বাঙলা/ এসএ