অবশেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ফিরল গণতন্ত্রের সুর। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আজ বুধবার (১৫ অক্টোবর), অনুষ্ঠিত হচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ পাচ্ছেন।
এত দিন নির্বাচন না হওয়ায় চবি ক্যাম্পাস কার্যত ক্ষমতাসীন দল অথবা প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনগুলোর একক দখলে ছিল। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল সমস্যা, যেমন আবাসনসংকট, খাবারের নিম্নমান, ও পরিবহনসংকটে কোনো সমাধান আসত না। ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বদলে প্রভাব বিস্তার ও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকত। হলগুলোর আসন বণ্টনও ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশে যেতে বাধ্য করা হতো, চলত নির্যাতন। প্রায়ই ক্যাম্পাসে মারামারি ও খুনের ঘটনা ঘটত।
গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জোরালো হয়। সেই ধারাবাহিকতায় শুরু হয়েছে নির্বাচনের নতুন প্রক্রিয়া।
এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ দুটি নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল জয়লাভ করেছে। চাকসু নির্বাচনের পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাকসু) ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার অদূরে হাটহাজারী উপজেলার গা ঘেঁষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ১৯৬৬ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। একই সময়ে গঠন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।
মূলত শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বেগবান করা, নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে চালু হয় চাকসু। কিন্তু নিয়মিত ভোট না হওয়ায় এসবের কিছুই হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫৯ বছরে মোট ছয়বার নির্বাচন হয়েছে চাকসুর—১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৯, ১৯৮১ ও ১৯৯০ সালে। চাকসুর প্রথম নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচিত হন যথাক্রমে মো. ইব্রাহিম ও মো. আবদুর রব। তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন বলে জানিয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতারা।
১৯৭২ সালের চাকসু নির্বাচনে ভিপি এবং জিএস পদে নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি শামসুজ্জামান হীরা ও ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না। এরপর ১৯৭৪ সালে তৃতীয় নির্বাচন হয়। এতে ভিপি এবং জিএস পদে নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের এস এম ফজলুল হক ও গোলাম জিলানী চৌধুরী।
ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বেশির ভাগ পদে জয়ী হয়েছে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল। আজ চাকসুর পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন।
চাকসুর চতুর্থ নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালে। এতে ভিপি এবং জিএস পদে নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী ও ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী। পঞ্চম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। এতে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন নেতা জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার।
অন্যদিকে সর্বশেষ নির্বাচনটি হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই নির্বাচনে চাকসুর ভিপি পদে নির্বাচিত হন ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের’ নেতা মো. নাজিম উদ্দিন ও জিএস পদে আসেন আজিম উদ্দিন আহমদ। মো. নাজিম উদ্দিন জাতীয় ছাত্রলীগের ও আজিম উদ্দিন আহমদ ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের তৎকালীন নেতা।
১৯৭২ সালে চাকসু নির্বাচনে ২৭টি পদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন জিতেছিল ২৪টিতে। আর ছাত্রলীগ পায় ৩টি। ওই কমিটি ক্যাম্পাসে নানা ধরনের ক্রীড়া, বিতর্ক, গান, নাটক, কবিতা পাঠের আসর করেছিল।
ওই নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন শামসুজ্জামান হীরা। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য।
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে নির্বাচন না হওয়ার কারণ হিসেবে শামসুজ্জামান হীরা বলেন, নব্বইয়ের পর সরকারগুলো ছাত্র সংসদের নির্বাচন চায়নি। তারা চেয়েছে নিজেদের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য ধরে রাখবে। এ কারণে নির্বাচন হয়নি।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক ভিপি এস এম ফজলুল হক বলেন, প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে পারতেন।
১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল—এই ২০ বছরে ক্যাম্পাসে খুন হন ১৫ জন। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এসব খুনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র তাপস সরকার।
চাকসুর কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতির ধারাও পাল্টে যায়। ছাত্ররাজনীতি চলে যায় পুরোপুরি ক্ষমতাসীনদের কবজায়। আশির দশকে ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাদের দাপট ছিল। তবে বিগত এক দশক ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করেছে ছাত্রলীগ (এখন নিষিদ্ধঘোষিত)। তারা দুই পক্ষ হয়ে রাজনীতি করেছে। এ দুই পক্ষ আবার ১১টি উপপক্ষে বিভক্ত ছিল। এসব উপপক্ষের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হতো। বিঘ্নিত হতো স্বাভাবিক পরিবেশ।
১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল—এই ২০ বছরে ক্যাম্পাসে খুন হন ১৫ জন। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এসব খুনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র তাপস সরকার। পুলিশ জানিয়েছে, খুনের ঘটনায় হওয়া মাত্র একটি মামলার বিচার হয়েছে।
চাকসুতে এবার ভোটার প্রায় ২৭ হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ১১ হাজার ১৫৬ জন। নির্বাচনে লড়তে প্রার্থী হয়েছেন ৯০৮ জন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে মোট ২৬ পদে লড়ছেন ৪১৫ প্রার্থী। একই সঙ্গে ১৪টি হল ও ১টি হোস্টেলে প্রার্থী হয়েছেন ৪৯৩ জন।
কেন্দ্রীয় সংসদে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ২৪ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ২২ জন ও সহসাধারণ সম্পাদক পদে ২২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
একেকটি হলে পদসংখ্যা ১৪। সে হিসাবে ১৪টি হল ও ১টি হোস্টেলে মোট পদ ২১০টি। ছাত্রীদের ৫টি আবাসিক হলে ৭০টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১২৩ জন। একজন করে প্রার্থী রয়েছে ১৬টি পদে। সে হিসাবে ৫৩টি পদে ভোট হবে।
চাকসুতে এবার ভোটার প্রায় ২৭ হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ১১ হাজার ১৫৬ জন। নির্বাচনে লড়তে প্রার্থী হয়েছেন ৯০৮ জন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে মোট ২৬ পদে লড়ছেন ৪১৫ প্রার্থী। একই সঙ্গে ১৪টি হল ও ১টি হোস্টেলে প্রার্থী হয়েছেন ৪৯৩ জন।
চাকসু নির্বাচনে লড়তে প্যানেল হয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে ছাত্রদলের প্যানেল; ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’, বামপন্থী ছাত্রসংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ১০টি সংগঠন মিলে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ (৩ পদে কেউ নেই), ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ প্যানেল ‘দ্রোহ পর্ষদ’ (৯টি পদে কেউ নেই) এবং জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্ট’স অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি ও ছাত্র ফেডারেশনের জোটবদ্ধ প্যানেল ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্যের’ মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আমারবাঙলা/এফএইচ