রাজধানীর তুরাগ ও উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় যৌনতার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে ছিনতাই ও প্রতারণা করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। চলতি সপ্তাহে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় এক সাংবাদিক খুন হওয়ার ঘটনায় চক্রটির কার্যক্রম নতুন করে আলোচনায় এসেছে। পুলিশ বলছে, এ চক্রের সঙ্গে জড়িত একাধিক নারী-পুরুষ, যাঁরা মূলত ‘হানিট্র্যাপ’ কৌশলে মানুষকে টার্গেট করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, হাউজ বিল্ডিং, রাজলক্ষ্মী, জসিমউদ্দীন রোড, আজমপুর ও বিমানবন্দর সংলগ্ন সড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছিনতাই, চুরি, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও খুনের ঘটনা। এসব অপরাধের মধ্যে সম্প্রতি ‘হানিট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে প্রতারণা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীরা।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সংঘবদ্ধ এই চক্রের সদস্যরা প্রথমে পুরুষ পথচারী বা যাত্রীদের লক্ষ্য করে। টার্গেট করা ব্যক্তিকে সুন্দরী তরুণীদের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে চক্রের অন্য সদস্যরা এসে ভয়ভীতি, মারধর বা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অর্থ, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়।
চলতি সপ্তাহেই গাজীপুরে চান্দনা চৌরাস্তায় ছুরিকাঘাতে খুন হন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। পুলিশ সন্দেহ করছে, তিনিও হানিট্র্যাপের ফাঁদে পড়েই প্রাণ হারিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানান, হানিট্র্যাপ চক্রের সদস্যরা প্রায়শই বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে। বিশেষ করে যারা শহরে অপরিচিত এবং একা চলাফেরা করছেন, তাদেরকে সহজেই প্রতারণার জালে ফেলে। শুধু হানিট্র্যাপ নয়, এসব এলাকায় ‘টানা পার্টি’ নামে পরিচিত ছিনতাইকারীরা গাড়ির জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন, পার্স বা ব্যাগ টেনে নিয়ে যায়। এসব চক্র দিনের বেলাতেই অপারেশন চালায়, যা রীতিমতো আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও বিমানবন্দর সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয় ছিনতাইকারীরা। একবার ছিনতাইয়ের পর ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে তাদের সময় লাগে না। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে মোবাইল ফোন, কারণ এগুলো দ্রুত বিক্রি বা পাচার করা যায়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, বর্তমানে হানিট্র্যাপ চক্রে যুক্ত রয়েছে কয়েক ডজন তরুণী, যাঁদের অনেকেই মাদকাসক্ত। তারা সংগঠিতভাবে কাজ করে। যদি কারও হাতে দামি মোবাইল বা টাকার ব্যাগ দেখা যায়, তাকে অনুসরণ করে ফাঁদে ফেলা হয়। এরপর অস্ত্রের মুখে মারধর করে সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং দলটি দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, তুরাগ, উত্তরা ও টঙ্গী এলাকায় অপরাধীরা দিনের বেলায়ও প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে। পুলিশ মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরলেও তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার আগের কাজে ফিরে যায়।
পুলিশ জানায়, এই চক্রের মূল হোতা ‘কে-টু মিজান’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে খুন, মাদক ও চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। তার স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপীও এই চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা দুজন গাজীপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একটি অপরাধচক্র পরিচালনা করে আসছিলেন।
গত শনিবার আদালতে নেওয়ার সময় সাংবাদিকদের উদ্দেশে কে-টু মিজান বলেন, ‘আপনারা নাটক-সিনেমা বানান, আমি করি রিয়েল।’ তার এই মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
চক্রটির আরো যেসব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন মো. স্বাধীন (২৮), আল আমিন (২১), শাহ জালাল (৩২), ফয়সাল হাসান (২৩), সাব্বির সুমন (২৬) ও শহীদুল ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মাদকের অন্তত ২৯টি মামলা রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘বেশিরভাগ ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করেন না। অনেকে ভয় বা সামাজিক সংকোচে বিষয়টি গোপন রাখেন।’ তবে সাংবাদিক হত্যা-পরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মো. মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘উত্তরায় ছিনতাইসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় কমেছে। এখন পর্যন্ত ২৫০ জনের বেশি ছিনতাইকারী ও অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’
আমারবাঙলা/এফএইচ