সংগৃহীত
জাতীয়

বুড়িগঙ্গার সাকার ফিশ ‘সাফা কইরা দিছেন’ মাঝি ফজলু 

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রী পারাপার করান নৌকার মাঝি খলিলুর রহমান (৪২)। বুড়িগঙ্গায় এখন সাকার ফিশ পাওয়া যায় কিনা, প্রশ্নে তিনি বলেন, সাকার ফিশ অনেকটাই কমে গেছে।

সাকার ফিশে ভরা ছিল দেশের অত্যন্ত দূষিত নদী হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গা। সে নদী থেকে এত সাকার ফিশ কোথায় গেল, জানতে চাইলে খলিলুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে বলেন ফজলু মিয়ার কথা।

‘ফজলু একাই সব সাফা কইরা দিছেন,’ বলেন খলিল। ফজলু মিয়াকে কোথায় পাওয়া যাবে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাকে পাওয়া যাবে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গার পাড়সংলগ্ন বেবি সাহেবের ঘাটে।

ফজলুর সন্ধানে বেবি সাহেবের ঘাটে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। আশপাশের মাঝিরা বললেন, ‘ফজলু এখন ভাইরাল।’ অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ফজলুর কীর্তি। মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুড়িগঙ্গায় যারা সাকার ফিশ ধরেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ফজলু। দিনের পর দিন তার মতো কেউ সাকার ফিশ ধরেনি।

মাঝিদের কয়েকজন জানান, ফজলু তার বাসায় আছেন। জুমার নামাজের পরে দেখা দেখা পাওয়া যেতে পারে, এমনটি জানালেন তারা। কেউ একজন খবর পাঠিয়েছেন ফজলুর বাসায়।

বেলা দুইটার আগে ফজলুর দেখা পাওয়া গেল ঘাটে আসার সরু পথে। কাছে এসে হাসিমুখে বললেন, ‘আমি ভাইরাল ফজলু।’

সাকার ফিশের মতো মাছ কেন ধরতে গেলেন, তা জানতে চাইলে ফজলু মিয়া (৪০) বলেন, ‘রাগে, ক্ষোভে।’

‘আগে বুড়িগঙ্গা থিকা থেকে শিং মাছ ধরতাম। সঙ্গে আসত অল্প কয়েকটা সাকার মাছ। গত বছর থিকা দেখি জাল ফেলাইলে ডজনে ডজনে এ মাছ উঠত। এত রাগ লাগতাছিল বলে বুঝাইতে পারব না,’ বলেন ফজলু।

ফজলুর ভাষ্য, তিনি তখনই সিদ্ধান্ত নেন, যত পারেন সাকার ফিশ বুড়িগঙ্গা থেকে তুলে ফেলবেন। এক বছর ধরে তিনি নিয়মিত সাকার ফিশ ধরেছেন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। তিনি মূলত ঝাঁকি জাল দিয়ে সাকার ফিশ ধরতেন।

মাস তিনেক আগে ফজলুর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায়, তিনি নৌকা বোঝাই করে সাকার ফিশ বিক্রি করছেন।

‘বুড়িগঙ্গার কোনোহানে এখন আগের মতো সাকার ফিশ পাইবেন না,’ যেন একটা যুদ্ধজয়ের গর্ব নিয়ে বললেন ফজলু। তিনি বলেন, প্রথম দিকে সাকার বিক্রি করার সময় অনেকে আমার সঙ্গে মজা করতেন। তবে একজন ৫০ টাকা দিয়ে দুই কেজি সাকার ফিশ কিনে নিয়েছিলেন।

‘যেদিন প্রথম বেচা শুরু করছি কেজি ২০ টাকা, অনেকে আইসা কয়, আগে তুই খাইয়া দেখা। আমি কইলাম, আমি খাইয়া দেখামু, তয় কেজি ৭০০ টাকা দেওন লাগব। এরপর ওই লোক আর মজা করে নাই,’ হাসতে হাসতে বলেন ফজলু।

ফজলুর ভাষ্য, ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর কয়েকজন পোলট্রি খামারি সাকার ফিশ কেনার জন্য সাভার থেকে এসেছিলেন। ওই দিন কাজে বাইরে ছিলেন ফজলু। ফলে তিনি তাদের কাছে মাছ বিক্রি করতে পারেননি। কেউ কেউ বিক্রি করেছেন।

কারা এসেছিলেন, জানতে চাইলে ফজলু বলেন, ‘সাভার থিকা আইছিল। মাছের খামার, পোলট্রি খামার, কেউ কেউ কুমিরের খামারের জন্যও লইয়া যায়।’

ফজলু দাবি করেন, তিনি সাকার ফিশ ধরার পর তা ফেলে দিতেন। কিছু কিছু বিক্রি হয়েছিল।

ফজলু মিয়া পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলা থেকে বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসেন প্রায় ৩০ বছর আগে। স্বামী, স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই নাতি মিলিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারে তিনি ও ছেলে আয় করেন। ছেলে লঞ্চের ডেকে পান বিক্রি করেন। টানাটানির সংসারে মেয়েকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন।

বেবি সাহেবের ঘাট এলাকাটি পড়েছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর খেজুরবাগ এলাকায়। এখানে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন ফজলু। ঘাট থেকে একটা সরু সড়ক সোজা চলে গেছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার দিকে। সেখানে মূলত নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা থাকেন।

ফজলুর বিষয়ে বেবি সাহেবের ঘাটে কথা হয় নৌকার মাঝি মো. সিরাজের (৬০) সঙ্গে। তিনি বুড়িগঙ্গায় যাত্রী পারাপার করেন। তিনি ফজলুকে চেনেন ২৫ বছর ধরে। থাকেন ফজলুর সঙ্গে একই এলাকায়।

সিরাজ বলেন, আগে নদীতে নামলেই সাকার ফিশ পায়ের নিচে পড়ত। পায়ের গোড়ালিতে লাগত। এহন আর গায়ে লাগে না। ফজলু সব সাফ কইরা ফেলাইছে।

ফজলু বলেন, বর্ষাকালে এ মাছ আবার ফিরে আসতে পারে। সে জন্য অনেক বড় একটা জাল বোনাচ্ছেন তিনি। বর্ষা আসতে আসতে জাল বানানো শেষ হবে। তখন সাকার যদি ফিশ না পাওয়া যায়, তাহলে অন্য মাছ ধরবেন তিনি। বর্ষায় বুড়িগঙ্গায় শিং, মাগুরসহ কিছু মাছ পাওয়া যায়।

সাকার মাছের ইংরেজি নাম সাকারমাউথ ক্যাটফিশ বা কমন প্লেসো। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াটিক স্টাডিজের তথ্যমতে, সাকার ফিশ মূলত দক্ষিণ আমেরিকার মাছের একটি প্রজাতি। এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের জলাধার ও নদীতে সাকার ফিশের আধিক্য বেড়েছে। এ ছাড়া এটি উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ছে।

এ মাছ দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে আসছে মৎস্য অধিদপ্তর। তাদের এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, সাকার ফিশ আশির দশকে ব্রাজিল থেকে অননুমোদিতভাবে বাহারি মাছ হিসেবে প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

অ্যাকুয়ারিয়ামের কাচে যে শেওলা জমে, তা খেয়ে পরিষ্কার রাখে সাকার ফিশ। এ কারণে অ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছ রাখা হয়। ধারণা করা হয়, বিদেশ থেকে আনা এই মাছ কোনোভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হার্ভেস্ট টেকনোলজি ২০২৩ সালে করা একটি গবেষণায় বলছে, বাংলাদেশে সাকার ফিশ প্রথম শনাক্ত হয় ২০০৮ সালে।

মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সাকার ফিশ নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুরে চাষ করা মাছের সঙ্গে ব্যাপকভাবে ধরা পড়ছে, যা জীববৈচিত্র্য তথা দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০২৩ সালে সরকার সাকার ফিশের আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, গ্রহণ বা প্রদান, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করে।

মৎস্য অধিদপ্তরের এই প্রচারপত্রে বলা হয়, দ্রুত বংশবৃদ্ধির কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা করে এই মাছ। দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে বংশবিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, সর্বোপরি জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে সাকার।

দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছসহ জলজ পোকামাকড়, শেওলা, ছোট শামুকজাতীয় প্রাণী খেয়ে সাকার ফিশ পরিবেশের সহনশীল খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট করে। জলাশয়পাড়ের ক্ষেত্রবিশেষ পাঁচ ফুট পর্যন্ত গর্ত করে পাড়ের ক্ষতি করে এবং জলাশয়ের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা কমায়।

ঢাকা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘২০২৪ সালে যখন প্রচুর সাকারে বুড়িগঙ্গা ছেয়ে গিয়েছিল, তখন আমরা জেলেপল্লিতে সাকার ধরার বিষয়ে প্রচারণা চালাই। তাদের সঙ্গে কয়েকটি মিটিংও করি।’

‘তারা আমাদের জাল ফেলে দেখিয়েছেন কী পরিমাণ সাকার ফিশ উঠে আসে। এ বছর শুনেছি, সাকার ফিশ নদীতে কমে এসেছে। এটি ভালো খবর আমাদের জন্য। জেলেদের অনুরোধ করেছি এ মাছ ধরার পর যেন মাটিতে পুঁতে ফেলেন,’ বলেন আয়েশা সিদ্দিকা।

সাকার ফিশকে কুকুর ও বিড়ালের প্রক্রিয়াজাত খাবারের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা, সেটি নিয়ে একটা গবেষণা করবেন বলে জানান আয়েশা সিদ্দিকা।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২২ সালে সাকার ফিশে ভারী ধাতব পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। এ গবেষণায় চারটি নমুনা পরীক্ষা করে সাকার ফিশে ভারী ধাতব পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

মাছ ও মুরগির খাবার হিসেবে সাকার ফিশের ব্যবহার কতটা নিরাপদ, তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, সাকার ফিশে ক্ষতিকর পদার্থ কী কী আছে, সেটির জন্য অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারী ধাতু পাওয়া গেলে সেটি মাছ ও মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ফুলকোর্ট সভা ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি

সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতিদের অংশগ্রহণে ফুলকোর্ট সভা...

যে কারনে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন,ব্যাখ্যা করলেন অজিত দোভাল

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত দোভাল বলেছেন, দুর্বল শাসন ব্যবস...

দেশজুড়ে সমবায়ের জয়যাত্রা, বঞ্চিত সিলেট বিভাগ

দেশজুড়ে যখন সমবায়ের জয়যাত্রা, তখন সিলেট বিভাগ যেন রয়ে গেছে উন্নয়নের মানচিত্রে...

সুদানে ভয়াবহ গণহত্যা চালালো আরএসএফ

সুদানের দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশার শহরে ভয়াবহ গণহত্যার চিত্র উঠে এসেছে। আবুবকর আ...

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে সরকার

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে এগোচ্ছে সরকার। ইতোমধ...

১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ২৬ টাকা কমালো সরকার

ভোক্তাপর্যায়ে এলপি গ্যাসের নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নভেম্বর মাসের জন্য...

কয়েকটি দলের মন রক্ষায় প্রধান উপদেষ্টা দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছেন: মঞ্জু

কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা দেশকে অনিশ্চিত গন্তব...

মোরেলগঞ্জে ভরা মৌসুমে সারের জন্য হাহাকার কৃষকরা

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের উপকূলে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে য...

বাংলাদেশ গ্রাহক বাজারে পাঁচ মাসেই মুখ থুবড়ে পড়ল স্টারলিংক

বাংলাদেশে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের যাত্রা...

আবারো জামায়াতের আমির হলেন ডা. শফিকুর রহমান

ফের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ‘আমির’ নির্বাচিত হয়েছেন ডা. শফিকুর...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা