সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক

‘পুঁতে ফেলব, কেউ জানতে পারবে না’

আমার বাঙলা ডেস্ক

সিরিয়ায় বাশার আর-আসাদের পতন হয়েছে। তার দুই যুগের শাসন শেষ হয়েছে মাত্র ১২ দিনের বিদ্রোহে! দেশটিতে আসাদ পরিবার ৫৪ বছর ধরে শাসন করেছে। বাবা হাফেজ আল-আসাদের পর শাসনভার নেন তার ছেলে বাশার। এ স্বৈরশাসকের সময় পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল।

তখন পুরো শহরে যুদ্ধের দামামা বাজছিল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল সহিংসতা। বাশারের সরকার দেশটির গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীদের দমনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। পরিস্থিতি এমন ছিল, যেকোনো মুহূর্তে কাউকে রাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলা হতে পারে।

সিরিয়ায় ২০১১ সালে বিক্ষোভ শুরু হয়। শুরু থেকেই দেশের ভেতরে অবস্থান করে সাংবাদিকতা করছিলেন বিবিসির লিনা সিনজাব।

বিক্ষোভ নিয়ে লিনা সিনজাবের পাঠানো প্রতিবেদন বিবিসিতে প্রচারিত হচ্ছিল। তার প্রতিবেদনে গুলি, হত্যা, গুম, বিমান হামলা, এমনকি ব্যারেল বোমা ব্যবহারের খবরাখবর উঠে আসছিল। তার প্রতিবেদনের মাধ্যমে মানুষ সিরিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে।

তবে ধীরে ধীরে আশা হারিয়ে ফেলেন লিনা সিনজাব। একপর্যায়ে তার নিজেকে কেমন অসাড় মনে হতে থাকে।

লিনা সিনজাবকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বাশার আল-আসাদের প্রশাসন তার চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে, প্রতিকূল হয়ে যায় যে ২০১৩ সালে লিনা সিনজাবকে দেশ ছাড়তে হয়।

গত এক দশক লিনা সিনজাব আশা-নিরাশার চরম দোলাচলের মধ্যে ছিলেন। বিদেশে বসে নিজের দেশকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে দেখেন তিনি।

মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ, আটক, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, লাখো মানুষের পালিয়ে যাওয়া, শরণার্থী জীবন কাটাতে বাধ্য হওয়া—এমন বহুবিধ ঘটনা ঘটতে দেখেছেন লিনা সিনজাব।

অন্যান্য অনেক সিরিয়ানের মতো লিনা সিনজাবেরও মনে হয়েছিল, বাকি বিশ্ব হয়তো সিরীয়দের কথা ভুলে গেছে। সুরঙ্গের শেষ প্রান্তে কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি।

সর্বশেষ আন্দোলনেও আশা দেখছিলেন না লিনা সিনজাব। ভাবতে পারেননি যে বিদ্রোহীরা আদতে সফল হবে। বিশেষ করে যখন বাশারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল রাশিয়া ও ইরান। কিন্তু গত রবিবার চোখের পলকে সব বদলে যায়।

গত সপ্তাহে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বসে বাশার আল-আসাদ-বিরোধী যোদ্ধাদের হাতে সিরিয়ার আলেপ্পো ও হামা শহরের পতনের প্রতিবেদন করছিলেন লিনা সিনজাব। কিন্তু তখনো তিনি ভাবতে পারেননি, আসলেই তার দেশে কোনো পরিবর্তন আসবে।

লিনা সিনজাব ভেবেছিলেন, সিরিয়া হয়তো দুই ভাগ হয়ে যাবে। রাজধানী দামেস্ক আর উপকূলীয় শহরগুলো বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

গত শনিবার মধ্যরাতের পর পরিস্থিতি আচমকা বদলে যায়। ভোররাত চারটা নাগাদ ঘোষণা করা হয়, বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

লিনা সিনজাব এখন বাশার আল-আসাদের পতনের কথা লিখছেন। অথচ এই তিনিই তখন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে আসলেই এমন ঘটনা ঘটে গেছে।

বাশার আল-আসাদের পতনের ঘোষণা আসার পর লিনা সিনজাব সিরিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গোপন পুলিশ সংস্থাগুলোর একটির (প্যালেস্টাইন ব্র্যাঞ্চ নামে পরিচিত) কাছ থেকে দেশে প্রবেশের অনুমতিপত্র পাওয়ার চেষ্টা করেন। সিরিয়ার বিক্ষোভ নিয়ে করা প্রতিবেদনের কারণে এই সংস্থার কাছে তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল।

২০১১ সালে সিরিয়ায় বিক্ষোভ শুরুর প্রথম সপ্তাহেই লিনা সিনজাবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই স্মৃতি তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি।

সারি বেঁধে দাঁড়ানো লোকজনকে মারধর করা, মেঝেতে তাজা রক্ত ছড়িয়ে থাকা, নির্যাতনের কারণে চিৎকার করা—এমন নানা ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল লিনা সিনজাবের।

বাশার আল-আসাদ সরকারের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা লিনা সিনজাবের মুখ চেপে ধরেছিলেন। ওই কর্মকর্তা লিনাকে বলেছিলেন, ‘আর একটা কথা বললে কেটে ফেলব।’

রবিবারই সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে লিনা সিনজাব সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, সেখানে আর বাশার আল-আসাদ সরকারের এই গোপন পুলিশ সংস্থার কেউ নেই। না নিরাপত্তারক্ষী, না তদন্তকারী—কেউই নেই। অথচ তিনি যখন গত জানুয়ারিতে সবশেষ সিরিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন, তখনো তাঁকে তাদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল।

সে সময় লিনা সিনজাবকে হুমকি দিয়েছিলেন এক তদন্তকারী। লিনা সিনজাবের ভাষ্যে, ‘তিনি আমাকে বলেছিলেন, সাততলা সমান মাটির নিচে পুঁতে ফেলবেন। কেউ জানতেও পারবে না।’

রবিবার লিনা সিনজাব অবাক হয়ে ভাবছিলেন, এই হুমকিদাতা কর্মকর্তা এখন কোথায়। হাজার হাজার মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা, হুমকি দেওয়ার বিষয় নিয়ে তিনি এখন কী ভাবছেন? কিংবা বাশার আল-আসাদের কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া মানুষদের নিয়ে তিনি কী ভাবছেন?

গ্রেপ্তার হওয়ার ভীতি ছাড়াই লিনা সিনজাব সীমান্ত পার হন। নিজ দেশে প্রবেশ করেন। এবার সিরিয়ায় ঢুকে তিনি যখন বাশার আল-আসাদের হাত থেকে মুক্ত দামেস্কে বসে বিবিসির জন্য প্রতিবেদন করছিলেন, তখন তার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে একটিবারের জন্যও ভয় লাগেনি।

দামেস্কের আকাশে এখন খুশির আমেজ। তবে যে বিদ্রোহী যোদ্ধারা সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ আছে। তা ছাড়া এই বিদ্রোহী যোদ্ধারা সিরিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান।

বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়া গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) যোদ্ধারা এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা দিচ্ছেন। তবে ইতোমধ্যে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে লুটপাট হয়েছে। কারাগার থেকে বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা বাশার আল-আসাদের আমলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা গত রবিবারের পর থেকে লিনা সিনজাবের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন। তারা দেশ ফিরবেন। তার মনে হয়, সবাই ফিরে আসতে চান।

২০১৩ সালে লিনা সিনজাব যখন দেশ ছেড়েছিলেন, তখনই দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে থাকা তার অ্যাপার্টমেন্ট ধ্বংস করে ফেলা হয়। তখন কর্তৃপক্ষ তাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেখানে তার বসবাস নিষিদ্ধ করেছিল কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় কর্মকর্তারা অ্যাপার্টমেন্টের দেয়াল ও সিলিং ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিলেন।

হাজারো ডলার ঘুষ দিয়ে গত মাসে লিনা সিনজাব তার অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা ফিরে পেতে সক্ষম হন। এখন এই অ্যাপার্টমেন্ট পুননির্মাণে তার বেশ খানিকটা সময় লাগবে। তবে তিনি তা করবেন।

অ্যাপার্টমেন্টটি আবার যখন বসবাসের উপযোগী হবে, তত দিনে সিরিয়া সবার ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে বলেই বিশ্বাস লিনা সিনজাবের।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

এমিতে ‘অ্যাডোলেন্স’-এর জয়জয়াকার

বাংলাদেশ সময় সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে ঘোষণা করা হলো ৭৭তম এমি অ্যাওয়ার্ডস।...

লন্ডনে বাংলাদেশি মাকে ‘বর্ণবাদী’ মন্তব্য, ছেলের ওপর হামলা

লন্ডনে হামলার শিকার হয়েছেন এক বাংলাদেশি তরুণ। তরুণের ভাষ্য, তাঁর হিজাব পরা মা...

রাকসু নির্বাচনে কার কী প্যানেল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-রাকসু নির্বাচনের এ পর্যন্ত নয়টি প্...

হাত না মেলানো : ভারতের ব্যাখ্যা, পাকিস্তানের প্রতিবাদ

আগা সালমান-শাহিন আফ্রিদিরা হয়তো সেটা ভেবেই মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন...

বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে তিস্তার পানি

টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি আব...

গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল: জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন

গাজার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের একটি স্...

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনা

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা আরও সুশৃঙ্খল করতে সরকারি হাসপাতালগুলোকে নতুন নির্দেশনা...

ক্রীড়া পরিদপ্তরে দুদকের অভিযান

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ক্রীড়া পরিদপ্তরের বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প...

এক লাফে ট্যারিফ বাড়ল গড়ে ৪০ শতাংশ

বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তি উপেক্ষা করেই নতুন ট্যারিফের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়...

বগুড়ায় মা ও ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা

বগুড়ার শিবগঞ্জে এক নারী ও তার কলেজপড়ুয়া ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা