ছবি: সংগৃহীত
পরিবেশ

পরিবেশ বিপর্যয়ে কুয়াকাটা সৈকত, ঝুঁকিতে লাল কাঁকড়া

পটুয়াখালী প্রতিনিধি

সমুদ্র সৈকতে লাল কাঁকড়া ছুটোছুটি আর রোদেলা দুপুরে সবুজ ঝাউবনের ছায়ায় বিশ্রামের জন্যই পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাকে বলা হয় ‘সাগর কন্যা’। পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় পর্যটকদের জন্য যে কয়েকটি আকর্ষণীয় উপাদান রয়েছে, সেগুলোর একটি লাল কাঁকড়া। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, সৈকতের বনাঞ্চল ধ্বংস এবং মানুষের কর্মকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে লাল কাঁকড়ার আবাসস্থল। ফলে হুমকিতে পড়েছে লাল কাঁকড়া, ক্রমেই কমে যাচ্ছে কাঁকড়ার সংখ্যা।

সৈকতের সবুজ বেষ্টনী এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি সংশ্লিষ্টদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুয়াকাটা থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বদিকে গঙ্গামতি এবং কাউয়ারচর সমুদ্র সৈকতটি এখনো নিরাপদ পর্যটক বিচরণক্ষেত্র। সমুদ্রের ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাগ ফেলায় পর্যটকদের বিচরণে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল সেটি আর নেই। কাউয়ার চরের লাল কাঁকড়ার বিচরণ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক পর্যটক।

এতে ধ্বংস হচ্ছে কাঁকড়ার বিচরণক্ষেত্র, মোটরসাইকেলের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা পড়ছে লাল কাঁকড়া। এছাড়া কাঁকড়া ধরে ছবি তোলার কারণেও তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় জেলে ইব্রাহীম বলেন, আগে এই যায়গায় অসংখ্য লাল কাঁকড়া থাকতো। এখন মানুষের হিংস্রতায় কাঁকড়ার সংখ্যা কমে গেছে।

কিছু দূরে ঝাউ বনের ভেতর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাসী। আবার কেউ কেউ সমুদ্রের ভাঙ্গনে উপড়ে পড়া গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা একটি চক্র দিনে ও রাতে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে উজাড় হচ্ছে বন আর আবাসস্থল হারাচ্ছে লাল কাঁকড়ার দল।

লাল কাঁকড়া সংরক্ষণের জন্য সৈকতের পশ্চিম প্রান্তের লেম্পুর বন এলাকায় গত সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) বন বিভাগ মহিপুর রেঞ্জের সহযোগিতায় গাছের ডালপালা দিয়ে কাঁকড়ার আশ্রয়স্থল তৈরির চেষ্টা চালানো হয়।

এ সময় বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, লাল কাঁকড়া রক্ষায় আমরা নিজ উদ্যোগে সীমিত আকারে কাজ করছি। সমুদ্রের ভাঙনে বন এবং লাল কাঁকড়া বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এরইমধ্যে লেম্পুবনে যানবাহন চলাচল রোধে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে। লাল কাঁকড়া রক্ষায় সরকারি এবং স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের সহযোগিতা আর সচেতনতা জরুরি।
তিনি আরো বলেন, সরকারী গাছ কাটা বা বিনষ্টকারীদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। নতুন করে ঝাউবন সৃষ্টির চেষ্টা করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য সবুজ দেয়াল তৈরিতে সকলের সহযোগিতায় কাজ করছি।

উপকূল পরিবেশ আন্দোলন কুয়াকাটা (উপরা) সভাপতি কে এম বাচ্চু বলেন, “২০২১ সালে আমরা প্রথম লাল কাঁকড়া ও কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য আলাদা অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানাই। তখন এগিয়ে আসে ওয়ার্ল্ডফিস বাংলাদেশ। সাময়িকভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা টেকসই হয়নি। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবছর উপড়ে পড়ছে জাতীয় উদ্যানের গাছ। অতিরিক্ত লবনাক্ততায় বনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মরে যাচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে চলাচলের রাস্তা। বালুক্ষয় থেকে রাস্তা রক্ষায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও লাল কাঁকড়া ও পরিবেশ রক্ষাকারী এবং সবুজ দেয়াল খ্যাত গাছ রক্ষায় এখনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সরকার। লেম্পুর বন এলাকার চার কিলোমিটার বনাঞ্চল এবং কাউয়ারচরের ৮ কিলোমিটার এলাকার বনাঞ্চল ও লাল কাঁকড়া বিচরণস্থল বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি দিন দিন আরো ভয়াবহ হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, লাল কাঁকড়া আমাদের উপকূলীয় পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। এরা সৈকতের মাটি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। আবাসভূমি ধ্বংস হলে পুরো বাস্তুসংস্থানের ওপর এর প্রভাব পড়বে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, বন উজাড় ও সৈকতের প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে লাল কাঁকড়ার প্রজনন ব্যাহত করছে। বন ও কাঁকড়া রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের গবেষণা সহকারী মো: বখতিয়ার রহমান বলেন, ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইউএসএআইডির অর্থায়নে ওয়ার্ল্ডফিশ-এর ইকোফিশ-২ প্রকল্প কুয়াকাটা সৈকতের দুই প্রান্তে বেড়া দিয়েছিলো যাতে লাল কাঁকড়া নির্বিঘ্নে চলাচল ও প্রজনন করতে পারে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে বেড়ার ভেতরে কাঁকড়ার সংখ্যা বাহিরের তুলনায় প্রায় ১৯ গুণ বেশি। পাশাপাশি যেখানে মানুষের উপস্থিতি কম, সেখানে কাঁকড়ার আকার বড়, রঙ উজ্জ্বল এবং সংখ্যাও বেশি থাকে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।

তিনি আরো বলেন, লাল কাঁকড়া মাটি খুঁড়ে এবং মৃত উদ্ভিদ-পাতা খেয়ে মাটিকে পুষ্টিকর ও বায়ু নিয়ন্ত্রিত রাখে। এতে মাটি উর্বর হয়, পানির শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়; নতুন গাছ জন্মায়। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী তৈরি হয়, যা পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, সৈকত ও উপকূল রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পর্যটন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের উন্নয়নে সহায়ক।

এ বিষয়ে ওয়েব ফাউন্ডেশন কলাপাড়ার ‘জলবায়ু সু-শাসন ও শক্তিকরণ প্রকল্প’ কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে অনেক আগ থেকেই। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ায় উপকূলীয় অঞ্চল বা সমুদ্র সৈকতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এর ফলে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাল কাঁকড়া বাসস্থান ও প্রজনন স্থান হারাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে কাঁকড়ার সংখ্যা। পাশাপাশি মাটির লবণাক্ততা এবং উপযোগী পানি স্বল্পতায় লাল কাঁকড়ার জীবন চক্র হুমকিতে পড়েছে।

আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

জনদাবী উপেক্ষা করেই কদমরসুল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু

সুবিধাভোগী জনগণের দাবী উপেক্ষা এবং বিতর্কের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষা নদী...

ছাত্রশিবিরের সাদিক ভিপি, ফরহাদ জিএস ও মহিউদ্দীন এজিএস নির্বাচিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়...

ডাকসুতে শিবির প্যানেলের বাইরে ৫ পদে জয়ী হলেন যারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভিপি-জিএস, এজিএসসহ...

শুভসূচনা আফগানিস্তানের

উদ্বোধনী ম্যাচ আবুধাবিতে। অথচ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় দুপুর পর্যন...

জাকসু নির্বাচন আগামীকাল

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন আগামী...

কোক স্টুডিও বাংলার নতুন গান ‘লং ডিসট্যান্স লাভ’ প্রকাশ

পৃথিবীতে যেখানে কণ্ঠস্বর মুহূর্তেই সাগর পেরোয়, আর যোগাযোগ মাত্র এক ক্লিক দূরে...

জাকসু নির্বাচন বর্জন করলো ছাত্রদল

জাকসু নির্বাচন বর্জন করছে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল। নির্বাচনে ভোট গ্রহণে কারচু...

স্নাতকে আসন না কমানোসহ ৪ দাবি ইডেন শিক্ষার্থীদের

স্নাতকে আসন সংখ্যা অতিরিক্ত হারে না কমানোসহ চার দফা দাবিতে মানববন্ধন করেছেন র...

এইটা ডাকসু না, এক্কেবারে ‘হিজাবসু’: নীলা ইসরাফিল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থি...

ভোট গণনার মেশিন নির্দিষ্ট দলের কোম্পানি থেকে কেনা : ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা