শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর আলোচনায় উঠে এসেছে তার ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শতাধিক নারীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হলেও কারোর রায়ই কার্যকর হয়নি। এমনকি গাজীপুরের কাশিমপুরে একমাত্র নারী কারাগারেও নেই কোনো ফাঁসির মঞ্চ।
গত রবিবার (১৭ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের কাছে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন বলেন, সিআরপিসিতে জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ, কিশোর, বালক ও শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে নারীকে কোনো আলাদা সুবিধা দেওয়া হয় না। সাধারণ আইন বা ট্রাইব্যুনাল আইন—কোনোটিতেই নারীদের জন্য আলাদা প্রিভিলেজ নেই। তাই রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আসামি নারী না পুরুষ, তা বিবেচ্য নয়; তার অপরাধের প্রকৃতি ও গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর আগে মামলার পঞ্চম ও শেষ দিনের যুক্তিতর্কে প্রসিকিউশনের প্রধান তাজুল ইসলাম আইনে বর্ণিত সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) দেওয়ার আরজি জানান। সোমবার ট্রাইব্যুনাল সেই ধারাবাহিকতায় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে।
কারা সূত্র জানায়, দেশের ইতিহাসে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো নারী আসামির ফাঁসি আজও কার্যকর হয়নি। কাশিমপুরের নারী কারাগারেও ফাঁসির মঞ্চ নেই। উদ্বোধনের সময় তৎকালীন আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জাকির হাসান জানিয়েছিলেন, অতীতে কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর না হওয়ায় সেখানে ফাঁসির মঞ্চ রাখা হয়নি।
এক হিসাবে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে শতাধিক নারীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তবে কেউই ফাঁসি কার্যকরের মুখোমুখি হননি—অনেকে দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তি পেয়েছেন, কেউ মারা গেছেন, আর কারো শাস্তি আপিলে কমেছে।
কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. জান্নাত-উল ফরহাদ জানান, সারা দেশে বর্তমানে ফাঁসির আসামি হিসেবে ৯৪ জন নারী বন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে কাশিমপুর কারাগারে আছেন ৩৪ জন।
শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ের আগ পর্যন্ত সর্বশেষ ফাঁসির আসামি ছিলেন বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তিনি বর্তমানে কাশিমপুর মহিলা কারাগারের মাধবীলতা সেলে বন্দি। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তার ফাঁসির রায় হলেও পাঁচ বছরেও তা কার্যকর হয়নি।
এ ছাড়া ফেনীর সোনাগাজী মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কামরুন্নাহার মণি ও উম্মে সুলতানা পপি, ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত গৃহকর্মী রীতা আক্তার, রুমা ওরফে রেশমা, মা–বাবাকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ঐশী রহমানসহ আরও অনেকে বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন। তাদের অনেকের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায়, কেউ আবার আপিল বিভাগে আপিল করেছেন। বেশির ভাগই পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের মামলার দণ্ডিত। আইনি জটিলতা ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের কারণে তাদের কারোরই ফাঁসি কার্যকর হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীদের ফাঁসি কার্যকরে আইনি বাধা না থাকলেও উচ্চ আদালতে শাস্তি হ্রাস, বিশেষ বিবেচনার বিধান, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা আবেদন না পৌঁছানো, ফাঁসির মঞ্চ না থাকা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি—এসব মিলেই নারীদের ফাঁসি কার্যকর হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফ জামিল বলেন, শেখ হাসিনার মামলা অন্য নারীদের মামলা থেকে ভিন্ন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধের রায়, যেখানে আসামি নিজেও পলাতক। তিনি দেশে ফিরবেন কি না বা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কি না—সেটা অনিশ্চিত। তার রায় কার্যকর হবে কি না, কবে হবে তা এখনই বলা যায় না। নারী হিসেবে তিনি সহানুভূতি দাবি করতে পারেন, তবে তা দেওয়া হবে কি না বলা কঠিন। অপরাধ ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন হওয়ায় তার ফাঁসি কার্যকর হলে সেটি প্রথমবার হলেও বিস্ময়ের কিছু হবে না।
আমারবাঙলা/এফএইচ