সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় জড়িতদের ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হচ্ছে– এমন আলোচনা কিছুদিন ধরেই রয়েছে। তবে এখন দায়মুক্তি নয়, নতুন মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
বুধবার (২৭ আগস্ট) মানি লন্ডারিং আইনে এই মামলার অনুমোদন দিয়েছেন সিআইডির মহাপরিচালক। আজকালের মধ্যে বনানী থানায় মামলাটি হওয়ার কথা রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি পাওয়া গেছে এই তালিকায় ৩৩ জন আছে। গতকাল সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। একই অভিযোগে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হবে।
এদের মধ্যে সিন্ডিকেটের হোতা রুহুল আমিন স্বপন, সাবেক তিন এমপি, তাদের স্ত্রী ও মেয়ে রয়েছেন, যাদের নামে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স আছে।
মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের মামলার আসামির তালিকায় থাকছেন– স্নিগ্ধা ওভারসিস লিমিটেডের কর্ণধার সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফাইভএম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মালিক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী জেসমিন মাসুদ ও মেয়ে তাসনিয়া মাসুদ। জেসমিন ও তাসনিয়া ফাইভএমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছাড়াও ওয়ান প্লাস ওভারসিসের পরিচালক। এ ছাড়া মামলায় আসামি করা হচ্ছে আহম্মেদ ইন্টারন্যাশনালের মালিক সাবেক এমপি বেনজীর আহমেদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তারা সবাই আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যে আ হ ম মুস্তাফা কামাল সিঙ্গাপুরে বলে জানা গেছে।
সিআইডির করা মামলায় ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ও বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপনও আসামি হচ্ছেন। তিনি মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর অন্যতম হোতা হিসেবে পরিচিতি।
গত ২০ আগস্ট স্বপনের ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ জব্দ করেছেন আদালত। ৭টি দলিলে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, উত্তরা ও বনানীতে ২৩১ কাঠা জমি রয়েছে তাঁর।
মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি না দিতে ১২ আগস্ট এক বিবৃতি দেয় অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ২৩টি সংগঠনের একটি মোর্চা। জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পুনঃতদন্ত এবং বিচারিক তদন্তের দাবি জানায় তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রথমে তদন্ত করেছে সিআইডি। অভিযুক্তরা মানি লন্ডারিংয়ে সংশ্লিষ্ট এমন তথ্য পাওয়ার পর মামলা দায়েরের অনুমোদন দেওয়া হয়। মামলায় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও তাঁর সঙ্গে জড়িত অন্যরা অন্তত ১০০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা হাতিয়েছে। তদন্তে এই অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আসামির তালিকায় রয়েছেন, ফাইভএম ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক সালাউদ্দিন মোরশেদ ভূঁইয়া, নূর মোহাম্মদ আব্দুল মুকিত ও মেহবুবা আফতাব সাথী।
আসামি করা হচ্ছে আদিব এয়ার ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরের কর্ণধার কে এম মোবারক উল্লাহ শিমুল, আগা ইন্টারন্যাশনালের মালিক সায়েম মোহাম্মদ হাসান, আকাশ ভ্রমণের কর্ণধার মনসুর আহম্মেদ কালাম, আমিয়াল ইন্টারন্যাশনালের শাহ জামাল মোস্তফা, বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের এম এম সোবহান ভূঁইয়া হাসান, ব্রাদার ইন্টারন্যাশনালের রফিকুল ইসলাম, গ্রিনল্যান্ড ওভারসিসের রেহেনা আঞ্জুমান হাই, ঐশী ইন্টারন্যাশনালের লিনা রহমান, সরকার ইন্টারন্যাশনালের মোহাম্মদ আলী সরকার, এসওএস ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস লিমিটেডের রাসেদ আবেদীন, আল রাবেতা ইন্টারন্যাশনালের আবুল বাশার, বেসিক পাওয়ার অ্যান্ড কেয়ার ওভারসিস লিমিটেডের মোহাম্মদ শাহ আলম চৌধুরী, দেশারী ইন্টারন্যাশনালের মো. আসলাম খান, ইস্ট ওয়েস্ট প্যারাডাইসের মো. ইউসুফ নবী, পাথ ফাইন্টার ইন্টারন্যাশনালের মাজহারুল ইসলাম, আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপম্যান্ট লিমিটেডের মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, জেজি আলফালাহ ম্যানেজমেন্টের মোহাম্মদ সোহেল রানা, কিসওয়া এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের রাজিব আহম্মেদ, প্রান্তিক ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেডের গোলাম মোস্তফা, আরআরসি হিউম্যান রিসোর্স সার্ভিস লিমিটেডের আলমগীর কবির, মুবিন এয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের রাকিবুল ইসলাম শাহিন, আল হেরা ওভারসিসের মো. রাশেদ খান ও ইউনাইটেড এক্সপোর্ট লিমিটেডের এস এম রফিক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে অভিযুক্তরা সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলেন। লে. জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরীসহ তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত অপর অভিযুক্তরা ৯ হাজার ৩৭২ কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছেন। ২০১৬ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ওই কর্মী পাঠান তারা। ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামে রিক্রুটিং এজেন্সি করেন। প্রথমে জনপ্রতি কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা করে আদায় করেছেন। এর বাইরে জনপ্রতি কর্মীর কাছ থেকে পাসপোর্ট ফি বাবদ ১০ হাজার টাকা, কভিড পরীক্ষার জন্য ১৭ হাজার টাকা, মেডিকেল ফি ছয় হাজার ৫০০ টাকা, পোশাক বাবদ তিন হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। যদিও সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় যেতে সরকার নির্ধারিত ফি ছিল ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা।
গত ১২ আগস্ট মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ২৩টি সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম)। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলে, অতীতে সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিচার করতে হবে। যেন কোনোভাবেই তারা নতুন করে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হতে না পারে।
বিবৃতিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পরিবারসহ সাবেক তিন সংসদ সদস্যকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এ ছাড়া মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম মালয়েশিয়াকিনি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণে জড়িত প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত স্থগিত করার মালয়েশিয়ার অনুরোধে বাংলাদেশ রাজি হয়েছে। এসব খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বিসিএসএম বলেছে, মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি না দেওয়া এবং অভিযোগের পুনঃতদন্ত এবং বিচারিক তদন্তের দাবি জানাচ্ছে তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে একেকজন কর্মীর কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে। কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ– দুই দেশেরই চক্র জড়িত।
আমারবাঙলা/জিজি