তিনবারের চেষ্টায় অবশেষে জাপানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী সানায়ে তাকাইচি। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের বিরাট ভক্ত তাকাইচি। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই হতে চান জাপানের ‘আয়রন লেডি’।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ৭০তম বার্ষিকীতে দলটির নেতা নির্বাচিত হন ৬৪ বছর বয়সী তাকাইচি। এর মধ্য দিয়ে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম হয় তার।
এক সময়কার সাবেক মন্ত্রী, উপস্থাপিকা ও হেভি মেটাল ব্যান্ডের ড্রামার ছিলেন তাকাইচি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় তার সামনে পর্বত সমান চ্যালেঞ্জ।
অর্থনৈতিক মন্দার সাথে লড়াই, নিম্ন জন্মহারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের কঠিন সম্পর্ক মোকাবেলা এবং কেলেঙ্কারি ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত ক্ষমতাসীন দলকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া মোটেও সহজ হবে না।
১৯৬১ সালে নারা প্রিফেকচারে জন্ম তাকাইচির। বাবা ছিলেন অফিস কর্মী, মা পুলিশ অফিসার। রাজনৈতিক আবহাওয়ার সঙ্গে শৈশবে কোনো পরিচয়ই ছিল না তার।
এক সময়কার হেভি মেটাল ড্রামার হিসেবে খ্যাতি ছিল তাকাইচির। কারণ ড্রাম বাজানোর পর স্টিক ভেঙে ফেলতেন তিনি। এ ছাড়া স্কুবা ডাইভিং ও গাড়ির প্রতিও তার ঝোক আছে। তার প্রিয় টয়োটা সুপ্রা এখন নারা জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
রাজনীতিতে আসার আগে তাকাইচি একটি টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে কিছু দিন কাজ করেছেন। আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বাণিজ্য যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখনই তাকাইচির রাজনীতিতে আসার অনুপ্রেরণা পান তিনি। জাপান সম্পর্কে মার্কিনিদের ধারণা কেমন, তা জানতে জাপানের সমালোচক ডেমোক্র্যাট মার্কিন কংগ্রেসওম্যান প্যাট্রিসিয়া শ্রো|ডারের অফিসে কাজ করেছেন তিনি।
তাকাইচি দেখেছেন, মার্কিনিরা জাপানি, চীনা ও কোরীয় ভাষা ও খাবারকে এক করে ফেলত। জাপানকে প্রায়ই দক্ষিণ কোরিয়া ও চীণের সঙ্গে গুলিতে ফেলত মার্কিনিরা।
এক পর্যায়ে তাকাইচি বলেছিলেন, ‘যদি জাপান নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, তাহলে তার ভাগ্য সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের মতামতের ওপর ঝুলে থাকবে।’
তাকাইচি ১৯৯২ সালে প্রথমবার পার্লামেন্ট নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। তবে মনোবল ভাঙেনি তার। এক বছর পর নির্বাচনে জেতেন তিনি এবং ১৯৯৬ সালে এলডিপিতে যোগ দেন। এরপর থেকে ১০ বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি, হেরেছেন মাত্র একবার। এর মধ্য দিয়ে দলের সবচেয়ে স্পষ্টবাদী রক্ষণশীল কণ্ঠস্বর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মন্ত্রী, বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং অভ্যন্তরীণ ও যোগাযোগ মন্ত্রীর মতো উচ্চপদস্থ সরকারি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তাকাইচি।
২০২১ সালে তাকাইচি প্রথমবার এলডিপি নেতৃত্বের দৌড়ে প্রবেশ করেছিলেন কিন্তু ফুমিও কিশিদার কাছে হেরে যান। ২০২৪ সালে তিনি আবার চেষ্টা করেছিলেন। এবার প্রথম রাউন্ডের ভোটে শীর্ষে ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিগেরু ইশিবার কাছে হেরে যান।
অবশেষে চলতি বছর তৃতীয় প্রচেষ্টায় তিনি জয় পান। পার্লামেন্ট তার নিয়োগ নিশ্চিত করার পর জাপানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে অনেকখানি এগিয়ে যান তাকাইচি।
সম্প্রতি প্রচারণা চালাতে গিয়ে তাকাইচি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য আয়রন লেডি হওয়া।’
তাকাইচি একজন কট্টর রক্ষণশীল রাজনীতিক। বিয়ের পরও নারীদের জন্মের সময়ের নাম বজায় রাখার আইনের তীব্র বিরোধিতা করে এসেছেন তিনি। সমকামী বিয়ের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি সুর নরম করেছেন এলডিপির এই নেত্রী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বেবিসিটার ফি আংশিকভাবে কর-ছাড়যোগ্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং অভ্যন্তরীণ শিশু যত্ন পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর জন্য করপোরেট কর ছাড়ের প্রস্তাব করেছিলেন।
প্রয়াত শিনজো আবের একজন অনুসারী হিসেবে তাকাইচি উচ্চ সরকারি ব্যয় এবং সস্তা ঋণের ‘আবেনোমিক্স’ অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
বিতর্কিত ইয়াসুকুনি মন্দিরে নিয়মিত যান তাকাইচি। সেখানে জাপানের যুদ্ধে নিহতদের সম্মান জানানো হয়, যাদের মধ্যে দোষী সাব্যস্ত যুদ্ধাপরাধীও রয়েছেন।
দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর সাংবিধানিক বিধিনিষেধ শিথিল করারও আহ্বান জানিয়েছেন এই রক্ষণশীল নেত্রী। জাপানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর আক্রমণআত্মক ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলডিপি জাপানের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু মন্থর অর্থনীতি, জনসংখ্যার পতন এবং সামাজিক অসন্তোষের হতাশার কারণে দলটি এখন ভিত্তি হারাচ্ছে।
জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন তাকাইচিজাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন তাকাইচি
এলডিপির ডানপন্থী অংশের রাজনীতিক তাকাইচি। তাকে নির্বাচিত করে রক্ষণশীল ভোতারদের কাছে টানতে চাইছে দলটি। কারণ এই ভোটাররা এরই মধ্যে কট্টর ডানপন্থী দল সানসেইতো পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
তবে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। তার সামনে এখন পর্বতসম চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি কতটা সক্ষম হবেন, তা সময়ই বলে দেবে।
সূত্র: বিবিসি
আমারবাঙলা/এফএইচ