আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পূর্ণোদ্যমে প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার দাবি করলেও, রোডম্যাপের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কার্যক্রমে ধীরগতি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে ইসির প্রস্তুতি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশনা থাকলেও ইসির ধীরগতি সেই সময়সীমা পূরণে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট আয়োজনের লক্ষ্য নিয়ে ইসি ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল ঘোষণার পরিকল্পনা করছে।
প্রধান উপদেষ্টার কড়া নির্দেশ, ইসির ধীরগতি
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করার জন্য ইসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। গত ২৮ আগস্ট ঘোষিত ইসির নির্বাচনী রোডম্যাপে মোট ২৪টি কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে আইন সংশোধন, সংলাপ, সীমানা নির্ধারণ ও সরঞ্জাম কেনা অন্যতম। ইসি কর্মকর্তারা প্রস্তুতির অগ্রগতি ৯০-৯৫ শতাংশ দাবি করলেও, কয়েকটি কার্যক্রমে দৃশ্যমান ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আরপিও সংশোধন নিয়ে তুমুল বিতর্ক
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত অনুমোদন পেলেও, এর কয়েকটি ধারা রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
জোটবদ্ধ নির্বাচন: জোটবদ্ধ হলেও সব দলকে নিজ প্রতীকে ভোট করার নতুন বিধান নিয়ে বিএনপি ও তার মিত্ররা আপত্তি জানিয়েছে। তারা পুরোনো বিধান বহাল রাখার দাবি জানিয়ে ইসি ও আইন উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল সংশোধিত বিধানের পক্ষেই রয়েছে।
জামানত বৃদ্ধি: আরপিওতে অস্বাভাবিক হারে জামানত বৃদ্ধির সিদ্ধান্তও অনেক রাজনৈতিক দলের নেতিবাচক সমালোচনার শিকার হয়েছে।
আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ কার্যকর হলে, ইসি সংসদ নির্বাচনে দল ও প্রার্থীর আচরণবিধির গেজেট প্রকাশ করবে। নির্বাচনী প্রচারণায় পোস্টারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করাসহ নতুন কয়েকটি সংযোজনও সমালোচিত হচ্ছে।
প্রবাসীদের ভোটদান: 'ধীরে চলো' নীতি
প্রথমবারের মতো প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও, এর প্রস্তুতি ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ইসির পরিকল্পনা ছিল প্রায় ৫০ লাখ প্রবাসীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, যার জন্য ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। তবে গত দুই বছরে মাত্র ১৫ হাজার ৮৭৭ জন প্রবাসী ভোটার হয়েছেন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়েছেন ১৩ হাজার ৯৯০ জন। প্রবাসীদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য নির্বাচনী অ্যাপটি আগামী ১৬ নভেম্বর উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও, ভোটের আগে বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর ভোট নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই সংশয় রয়েছে।
সীমানা নির্ধারণে জটিলতা ও রিট
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রম শুরু থেকেই ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়ে। চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশের পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, ক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অন্তত ২০টি আসনের সীমানা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে ২৭টি রিট আবেদন হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার রিটের কারণে নির্বাচনে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা প্রকাশ করলেও, তপশিল ঘোষণার আগেই ইসিকে আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
নতুন দল নিবন্ধন ও সংলাপ অনিশ্চয়তা
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করতে সাড়ে সাত মাস সময় লেগে যাওয়ায় তা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী, নিবন্ধন কার্যক্রমের শেষ দিন ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর।
বিতর্কিত দল নিবন্ধন: জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগের মতো নিষ্ক্রিয় দলগুলোকে নিবন্ধনের প্রাথমিক তালিকায় রাখায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।
এনসিপি প্রতীক সংকট: জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) 'শাপলা' প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইসি সংকটে পড়েছে।
নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ ও তাদের মতামত ছাড়াই ইসি আরপিওসহ গুরুত্বপূর্ণ আইনবিধি সংশোধন করায় ক্ষুব্ধ দলগুলো নির্বাচনী মাঠে আরও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে।
পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন নিয়েও প্রশ্ন
দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে ৭৩টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার তালিকা প্রকাশের পর জানা যায়, অনেক সংস্থাই নামসর্বস্ব এবং তাদের অফিস বাসা-বাড়ি কিংবা পরিত্যক্ত ঘরে। এই বিতর্কের কারণে পর্যবেক্ষক সংস্থার চূড়ান্ত নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন নতুন করে ভাবছে। ইসি সচিব আখতার আহমেদ অবশ্য চলতি সপ্তাহের মধ্যেই রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করার আশ্বাস দিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা: সশস্ত্র বাহিনীর সংযোজন
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিশেষত 'মব সন্ত্রাস' ভোটের পরিবেশকে বিঘ্নিত করবে বলে শঙ্কা থাকলেও, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সঙ্গে বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীসহ সবগুলো বাহিনী অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছে। বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাসদস্যদের ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়ে ভিন্নমত
ভোটের দায়িত্বে থাকা সাড়ে ১০ লাখের বেশি কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ বেশির ভাগ দল গত তিনটি নির্বাচনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বিএনপি সুনির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের (ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতাল ইত্যাদি) কর্মকর্তাদের ভোটের দায়িত্বে না রাখার দাবি করে চিঠি দিয়েছে, যার কঠোর সমালোচনা করেছে জামায়াতে ইসলামী।
আশা ও অগ্রগতি
নানা বিতর্ক সত্ত্বেও ইসি আইন ও বিধি সংস্কার, ভোটের সরঞ্জাম কেনা, ভোটকেন্দ্র চূড়ান্তকরণ এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদের মতো কাজে অগ্রগতি দেখিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ জানান, 'ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য সবধরনের প্রস্তুতি চলছে। আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক রদবদল, রিটার্নিং অফিসার ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগসহ সব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমরা পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছি।'
ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ আশাবাদী, 'নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতির অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। প্রস্তুতির দিক থেকে আমরা সামান্য পিছিয়ে আছি। তবে আতঙ্কিত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার মতো কোনো কারণ বা পরিস্থিতি নেই।'
আমারবাঙলা/এফএইচ