পটুয়াখালীর সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালী যেন লুকিয়ে থাকা এক টুকরো স্বর্গ। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে পূর্ব দিগন্তে সূর্যোদয় আর পশ্চিমে সূর্যাস্তের রঙিন খেলা দেখা যায় অবলীলায়। সাগরতটে ছুটে বেড়ানো লাল কাঁকড়ার দল, গর্জে ওঠা ঢেউ, আর চারদিকজুড়ে কেওড়া–গেওয়ায় ঘেরা ঘন সবুজ বন—সব মিলিয়ে রাঙ্গাবালী যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা জীবন্ত ক্যানভাস।
দীর্ঘদিন অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতায় সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকলেও এখন পদ্মা সেতুর কারণে বদলে গেছে পরিস্থিতি। সময় কমে আসায় বাড়ছে দেশি–বিদেশি পর্যটকের পদচারণা। ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে এখন সমান জনপ্রিয় রাঙ্গাবালীর চারটি সৈকত—জাহাজমারা, তুফানিয়া, সোনারচর ও চরহেয়ার।
জাহাজমারা—সমুদ্র জলের আঁচড়ে গড়া বিস্ময়:
রাঙ্গাবালীর মৌডুবী ইউনিয়নের জাহাজমারা দ্বীপ যেন রূপকথার দৃশ্য। ভাটার সময় সমুদ্রের জল নামতে শুরু করলে বালুভূমিজুড়ে লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপে স্থানীয়রা বলেন—“এ যেন কাঁকড়ার আঁকা আলপনা।” সাগরের নীল জলে মাছেদের ছোটাছুটি আর পাখিদের কলরব পুরো সৈকতকে জীবন্ত করে রাখে।
একসময় এই অঞ্চলের নাম ছিল চরবগলা। ব্রিটিশ আমলে আন্তর্জাতিক নৌরুটে ব্যবহৃত একটি বিদেশি জাহাজ এখানে আটকা পড়ে ধীরে ধীরে ডুবে যায়। সেই ঘটনার স্মৃতিতেই নতুন নাম হয়—জাহাজমারা। দীর্ঘদিন ধরে আগুনমুখা নদীঘেরা এই দ্বীপ বহু ভ্রমণপিপাসুকে টেনে আনছে।
সোনারচর, তুফানিয়া ও চরহেয়ার—চার ঋতুর রঙে রাঙানো প্রকৃতি:
সোনারচরের বালুর ওপর সূর্যের আলো পড়লে মনে হয় সোনালি প্রলেপ লেগে গেছে। সুন্দরবনের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপ এখন দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। সোনারচর থেকে খুব কাছে তুফানিয়া ও চরহেয়ার—দুটি ছোট দ্বীপ কিন্তু অপরূপ সুন্দর। তিনটি দ্বীপ মিলেই যেন রাঙ্গাবালীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ত্রিমাত্রিক মঞ্চ।
যোগাযোগে বদলে গেছে ভ্রমণের ধরণ:
ঢাকা থেকে সরাসরি গলাচিপা যেতে বাসভাড়া ৬০০–৭০০ টাকা। সেখান থেকে পানপট্টি বা বোয়ালিয়া ঘাট হয়ে স্পিডবোটে ১৫০ টাকা বা লঞ্চে ৬০ টাকায় রাঙ্গাবালী যাওয়া যায়। সদরঘাট থেকেও রাঙ্গাবালীগামী লঞ্চ ছাড়ে—সিঙ্গেল কেবিন ১,৩০০ ও ডাবল কেবিন ২,৫০০ টাকা।
আগে ঢাকা থেকে রাঙ্গাবালী পৌঁছাতে সময় লাগত ১৫–১৮ ঘণ্টা। এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ৭–১০ ঘণ্টা সময় কমেছে, যা পর্যটকদের আরও অনুপ্রাণিত করছে।
জাহাজমারায় পৌঁছানোর অতিরিক্ত পথ:
গলাচিপা থেকে একতলা লঞ্চে মৌডুবী পৌঁছে সেখান থেকে মোটরসাইকেলে জাহাজমারা যাওয়া যায়। আবার কুয়াকাটা, পায়রা বন্দর, পানপট্টি বা কলাপাড়া থেকেও ট্রলার ও নৌযানে বেড়াতে আসছেন অনেক পর্যটক।
পর্যটনসুবিধা:
চরমোন্তাজ ইউনিয়নে বন বিভাগের রেস্টহাউজ। উপজেলা শহরে আবাসিক হোটেল ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। জাহাজমারায় বেসরকারি কটেজ নির্মাণাধীন। সৈকতে যাত্রীছাউনি, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও গভীর নলকূপ। নতুন ট্যুরিস্ট জোন গড়ে তোলার সরকারি পরিকল্পনা রয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছেন, পানপট্টি–কোড়ালিয়া ঘাটে ফেরি সার্ভিস চালু ও দাড়ছিঁড়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। চরগঙ্গা থেকে জাহাজমারা সৈকত পর্যন্ত সড়ক পাকাকরণও তাদের পরিকল্পনায় আছে—যা বাস্তবায়ন হলে সড়কপথে ভ্রমণ আরও সহজ হবে।
পর্যটনে সম্ভাবনাময় এই অঞ্চল পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে দ্রুত। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, সাগরের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ, লাল কাঁকড়া ও অনাবিল সৌন্দর্যের কারণে রাঙ্গাবালী এখন দেশের নতুন আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে।
আমারবাঙলা/আরআরপি