বাংলাদেশের মোশন গ্রাফিক্স ও টেলিভিশন ব্র্যান্ডিং খাতের এক অসামান্য সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব দেবাশীষ দাস এবার অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক সম্মাননা ‘বঙ্গ গৌরব সম্মান (আন্তর্জাতিক)’। এই মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি তাঁকে প্রদান করে ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়া সংগঠন Bolo Kolkata TV। ২ ও ৩ আগস্ট ২০২৫ তারিখে কলকাতার সুজাতা সদন, হাজরা, কালীঘাটে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আয়োজন ‘Banga Gourab Utsab Season 5.1 Pro’, যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত গুণীজনদের উপস্থিতিতে তাঁকে “International Motion Graphics Leader” হিসেবে এই সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
এই আয়োজনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় গুণী মানুষের প্রকৃত অবদানের উপর। এশিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত শিল্পী, উদ্যোক্তা, শিক্ষক, সংগঠক, ডিজাইনার ও সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্য থেকে একটি স্বতন্ত্র ও পেশাদার জুরি বোর্ডের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে সেরা ব্যক্তিত্বদের নির্বাচন করা হয়। সেই কঠিন বাছাই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে জায়গা করে নেন বাংলাদেশের দেবাশীষ দাস।
অনুষ্ঠানে দুই দিনব্যাপী ছিল এক মনোমুগ্ধকর সংস্কৃতি-সম্ভার। আয়োজনে পরিবেশিত হয় বর্ণাঢ্য নৃত্য পরিবেশনা, আবৃত্তি, কণ্ঠসংগীত, নাট্যাংশ, ম্যাজিক শো এবং ঐতিহ্যবাহী উপস্থাপনাগুলোর এক ঝলক। দেবাশীষ দাস অনুষ্ঠানে ছিলেন International Guest of Honour হিসেবে, যেখানে তাঁর কাজ ও অবদানকে তুলে ধরা হয় মূল মঞ্চে। উপহারস্বরূপ তাঁকে প্রদান করা হয় একটি সম্মাননা স্মারক, সনদ এবং বিশেষ আন্তর্জাতিক পদক—যা তাঁর ক্যারিয়ারের আরও এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এই সম্মাননা দেবাশীষ দাসের চলতি বছরের তৃতীয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এর আগে তিনি ২ আগস্ট ২০২৫-এই ঢাকার কচি-কাঁচা মিলনায়তনে আয়োজিত ‘দক্ষিণ এশিয়া স্টার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’-এ ভূষিত হন ‘সৃজনশীল ব্র্যান্ডিংয়ে আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব’ ক্যাটাগরিতে। একই বছর তিনি অর্জন করেন ‘স্টার বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’-এ ‘Digital Branding Leader of the Year’ এবং ‘এক্সেলেন্স ইন সাকসেস অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’-এ ‘সেরা মোশন গ্রাফিক্স আর্টিস্ট (প্রোগ্রাম ব্র্যান্ডিং)’ খেতাব। এর আগের বছর, ২০২৪ সালে, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং সংস্থা লেজার ট্রিট তাঁকে প্রদান করে 'Best in Brand Communication' সম্মাননা।
তাঁর এই অর্জনগুলোর পেছনে রয়েছে দুই দশকের নিষ্ঠা, গবেষণা এবং সৃজনশীল প্রচেষ্টা। ২০০৭ সালে RTV-তে মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়। এরপর যমুনা টেলিভিশনে কাজ করে তিনি দেশে প্রোগ্রাম ব্র্যান্ডিংয়ে এনেছেন ভিন্নধর্মী শৈলী ও গভীরতা। বর্তমানে তিনি মাছরাঙা টেলিভিশনের গ্রাফিক্স বিভাগের উপ-ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জনপ্রিয় প্রোগ্রামের ভিজ্যুয়াল পরিচিতি ও ব্র্যান্ডিংয়ের পেছনে কাজ করছেন।
দেবাশীষ দাস শুধু একজন ডিজাইনার নন, তিনি একজন শিক্ষক, গবেষক ও অনুপ্রেরণাদানকারী মেন্টরও। ২০১৮ সাল থেকে তিনি পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট-এ মোশন গ্রাফিক্স ফ্যাকাল্টি হিসেবে কাজ করছেন এবং ২০২২ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগে গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে যুক্ত আছেন। তাঁর শিক্ষাদান কেবল সফটওয়্যার নির্ভর নয়, বরং নান্দনিকতা, স্টোরিটেলিং ও ব্র্যান্ড মনস্তত্ত্ব—সব মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ ভিজ্যুয়াল কনসেপ্ট তৈরিতে শিক্ষার্থীদের সক্ষম করে তুলছেন।
সম্প্রতি তিনি ছিলেন ‘For a Better, Greener Earth’ আন্তর্জাতিক মোশন গ্রাফিক্স প্রতিযোগিতার বিচারক, যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক মানের কাজ মূল্যায়ন করেন ও তরুণ ডিজাইনারদের মূল্যবান পরামর্শ দেন। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এমন বৈশ্বিক পরিসরে বিচারকের আসনে বসা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য গর্বের বিষয়।
গ্রাফিক ডিজাইনের বাইরে তিনি কাজ করছেন প্রকাশনা শিল্পেও। প্রায় দুই শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন তিনি এবং কাজ করেছেন দেশবরেণ্য লেখকদের সঙ্গে। তাঁর কাজগুলোতে দেখা যায় রঙের সংযমী ব্যবহার, আর্কিটেকচারাল কম্পোজিশন, টাইপোগ্রাফির সূক্ষ্মত্ব এবং আবেগময় থিমের উপস্থিতি।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, শুধু ডিজাইন আর শিক্ষার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি দেবাশীষ দাস। তিনি যোগব্যায়াম ও মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিয়েও কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি যোগা ও মেডিটেশন নিয়ে বেশ কয়েকটি সেমিনার পরিচালনা করেছেন, যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনার উপায় নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর মতে, সৃজনশীল কাজের জন্য মন ও শরীর দুটোই সুস্থ রাখা জরুরি, এবং সেই লক্ষ্যে তিনি নিয়মিত চর্চা করেন ধ্যান ও যোগব্যায়াম—এবং অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করছেন।
‘বঙ্গ গৌরব সম্মান (আন্তর্জাতিক)’ প্রাপ্তি কেবল একটি পদক নয়—এটি তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রম, শিল্পমনা দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক মানের নেতৃত্বের একটি অনন্য স্বীকৃতি। বাংলাদেশের ডিজিটাল শিল্প, মিডিয়া ব্র্যান্ডিং ও সুস্থ জীবনের দর্শনে তাঁর প্রতিটি অর্জন আজ নতুন প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা।