বাণিজ্য

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অসম বাণিজ্য চুক্তির পথে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে নানা উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির দিকেই এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর সেটি এমন সময় হচ্ছে, যখন ট্রাম্প প্রশাসন আগের তুলনায় বাণিজ্যে কঠোর শুল্কনীতি অনুসরণ করছে, বিশেষত এশীয় দেশগুলোর ওপর।
দরকষাকষির ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম তুলনামূলক কম শুল্ক সুবিধা পেতে যাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশের রফতানিপণ্য পড়ছে ৩৫ শতাংশ শুল্কের মুখে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, বাণিজ্য চুক্তিটি দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যৎ রফতানি প্রবৃদ্ধির জন্য এক কৌশলগত পদক্ষেপ।


রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফা আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের কারণে চুক্তির শর্তগুলোর বিষয়ে যদিও কেউ উন্মুক্তভাবে কোনো কথা বলছেন না। তবে সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, চুক্তিতে শুল্কের বিষয় ছাড়াও অনেক উপকরণ রয়েছে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেগুলো নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে।


চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পূর্ণভাবে আলোচনা না করলেও খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় সরকার জানিয়েছে, যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে তার ৮০-৮৫ শতাংশের বিষয়ে সম্মত হয়েছে তারা। বাকি ১৫-২০ শতাংশ নিয়ে আলোচনা চলছে। সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, অমীমাংসিত বিষয় সবগুলো নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা যাবে কিনা এখনো নিশ্চিত না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করবে বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্টে আসতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ খুব আকর্ষণীয় কোনো দেশ না। তারা দেখছেন, বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব বড় না হলেও তা কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের সামগ্রিক ক্রয় সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চুক্তির দরকষাকষি বিষয়ে সরকারের আহ্বান করা আলোচনা সভায় অংশ নেয়া একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এ চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকারে রেখে বাংলাদেশের সক্ষমতা পরিমাপের বিষয় আছে। ইন্দোনেশিয়া ৫০টি বোয়িং কিনতে চায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির চুক্তির অংশ। বাংলাদেশ কি ৫০টি বোয়িং ক্রয়ের সক্ষমতা রাখে? আবার ভারত যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান কিনতে চায়। এভাবে দেশভেদে সক্ষমতা বিবেচনায় চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ঘটছে পর্দার আড়ালে। বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ স্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় ধরনের ক্রয় বাস্তবসম্মতও হবে না।

এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানও দেশভেদে চুক্তি সম্পন্নের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। যেমন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি ত্বরান্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক বড় কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হচ্ছে চীনকে ঠেকানো। এ কারণে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তি করতেই হবে।’

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সূত্র থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্টের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দেশটির ওপর ২০ শতাংশেরও কম পাল্টা শুল্ক আরোপ হবে বলে দাবি করছেন ভারতের চুক্তিসংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখন পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে শুধু যুক্তরাজ্যের।

আবার কিছুদিন আগেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ার পণ্যের ওপর ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পর গত বুধবার জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা পণ্যে শুল্ক কমিয়ে ১৯ শতাংশ করা হয়েছে। দেশটির সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, এ শুল্ক আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরেক দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গেও একটি বাণিজ্য চুক্তিতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যার আওতায় ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে। ৩ জুলাই সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, নতুন এ চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর নতুন করে পাল্টা কোনো শুল্ক আরোপ করছে না ভিয়েতনাম।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে কেন? এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে প্রভাব খাটানোর মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশের। এ বাস্তবতার পাশাপাশি রয়েছে দরকষাকষিতে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় কৌশল ও প্রস্তুতিগত ঘাটতি।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব দেশে চীনের প্রভাব রয়েছে। এ অঞ্চলে ইন্দোনেশিয়া অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় অনেক বড় দেশ। মালয়েশিয়ার রফতানির আকার ২৫০ বিলিয়ন ডলারের। দেশটি চাইলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক কিছু আমদানি করতে পারে। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একদমই আকর্ষণীয় কোনো পক্ষ নয়। তাদের আকৃষ্ট করতে বড় ধরনের লেভারেজ (প্রভাব খাটানোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা) বাংলাদেশের নেই। ট্রাম্প জোর দিচ্ছেন সামরিক সরঞ্জাম কিনতে, যা অনেক বেশি দামি এবং সেগুলো ক্রয়ের সক্ষমতায় বাংলাদেশের ঘাটতি রয়েছে।

আবার সক্ষমতার পাশাপাশি এখানে কৌশলগত বিষয়ও রয়েছে। ট্রাম্প তার প্রস্তাবে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি পরিমাণে গম কিনতে হবে। বাংলাদেশ অনেক গম কিনতে শুরু করলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রয় প্রত্যাশার কাছাকাছি হবে না। আবার এলএনজি আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আসতে বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে না। কারণ এলএনজি বৈশ্বিক বাজার থেকে কিনলে অনেক কম দামে পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ প্রথম দুই দফায় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শেষ করে ফিরে এসেছে। চলছে তৃতীয় দফা দরকষাকষিতে যাওয়ার প্রস্তুতি। আলোচনায় বসতে সময় চেয়ে বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরের অপেক্ষায়।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চুক্তির বিভিন্ন শর্ত বা দিক নিয়েও রয়ে গেছে উদ্বেগ। কেননা কোনো সার্বভৌম দেশের পক্ষে এ চুক্তির অনেক শর্ত মানা কঠিন। ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলো ট্যারিফ হারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেটা বাংলাদেশকেও অনুসরণ করতে হবে। আবার কোনো একটি দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ বা বাণিজ্য করা যাবে না। কোনো দেশের ওপর যদি অতিরিক্ত কোনো শুল্ক আরোপ করা হয়, বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে।

এমনকি নির্দিষ্ট একটি দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও সমরাস্ত্রবিষয়ক কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশ জড়াতে পারবে না—এমন শর্তও দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। এ বিষয় নিয়ে ঢাকায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্র সরকারসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও সমরাস্ত্রবিষয়ক কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশ যেন সম্পৃক্ত না হয়—এমন কিছু শর্ত থাকতে পারে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে। এছাড়া রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, সয়াবিন আমদানি বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানি নিয়ে চুক্তি করা। ক্ষেত্রবিশেষে এসব চুক্তি মেনে চলা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক নাও হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেভাবে বিবেচনাযোগ্য কোনো রাষ্ট্র নয়। যার প্রতিফলন হিসেবে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি খুব বেশি না হলেও অনেক বেশি শর্ত জুড়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে একটা অসম বাণিজ্য আলোচনা চলছে। দেশটির প্রস্তাবে নন-ট্যারিফ এলিমেন্টগুলো অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জের।’

দরকষাকষিতে বাংলাদেশের লেভারেজ খুবই কম, এ কারণে বাংলাদেশের চেয়ে অন্য দেশগুলো হয়তো অগ্রাধিকার পেতে পারে বলে মনে করেন ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘অ্যাপারেন্টলি মনে হচ্ছে নন-ট্রেড এলিমেন্ট এবং সিকিউরিটি এলিমেন্টস অনেক বেশি। এগুলোর কয়টা মানা সম্ভব সেটা যারা নেগোসিয়েশন করছেন তারাই বুঝতে পারছেন। এসব কারণে আমরা হয়তো কিছুটা পিছিয়ে আছি। সরকারের সঙ্গে সভায় আমাদের জানানো হয়েছে, প্রস্তাবিত চুক্তির ৯০ শতাংশ বিষয় সমাধান করা হয়েছে। কিছু অনিষ্পন্ন ইস্যু আছে যেগুলো দেখা হবে। তবে এ অসম বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে যদি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে বাণিজ্য সুবিধা দেয়া হয়, তা মোটেও ন্যায্য হবে না। ভূরাজনৈতিক বিষয় এক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।’

আর্থিক সক্ষমতা ও কৌশলগত বিষয় বিবেচনার পাশাপাশি দরকষাকষিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির দরকষাকষির জন্য বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের বিষয়ে সমন্বয়হীনতা দেখিয়েছে। আবার নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট নিয়ে বোঝাপড়ার ঘাটতিতে চুক্তির বিষয়বস্তু নিয়ে ধোঁয়াশা বা বিভ্রান্তি থেকে বের হতে পারেনি।

জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘মালয়েশিয়া গণমাধ্যমে দেশের মানুষকে জানাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র কী চাইছে। সব না জানালেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তারা জানাচ্ছে। আবার দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞ মতামতও চাওয়া হয়েছে। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের আহ্বানে ট্যারিফ-পরবর্তী প্রভাব মূল্যায়নে আমি অংশগ্রহণ করছি। এসব কিছু মিলিয়ে প্রশ্ন জাগে এনডিএ (নন-ডিজক্লোজার এগ্রিমেন্ট) কি শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে! অন্য দেশের সঙ্গে এনডিএ ওইভাবে কাজ করছে না। মালয়েশিয়া অনেক দিক থেকে সমৃদ্ধ একটা দেশ এবং তারা নেগোসিয়েট করছে। তারা মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে সেসব বিষয়ে জানাচ্ছেও। ভিয়েতনাম ট্রাম্পের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ ঘোষণার পরপরই গুরুত্বপূর্ণ লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছিল। দেশটি ট্রাম্পের সঙ্গে বহু বিশেষজ্ঞভিত্তিক দল গঠন করে জড়িত হয়েছে। আবার ভারতের দরকষাকষির পরিসরটাও অনেক বড়। দেশটি সময়ে সময়ে খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের ক্রিটিক্যাল পরামর্শ নিচ্ছে।’

সেলিম রায়হান আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার অংশীজনদের সঙ্গে সভা করলেও যথাযথভাবে পরামর্শ দেয়া যাচ্ছে না, কারণ চুক্তিসংক্রান্ত তথ্যগুলো পরিষ্কার না। সব মিলিয়ে অনেক দেশ এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে সেই প্রশ্ন রয়েই যায়। আমি আশা করব একটা ভালো আউটকাম হবে। কিন্তু বড় একটা উদ্বেগের জায়গা আছেই। অন্য দেশগুলো তুলনামূলক রিজনেবল ডিল করতে পারলেও বাংলাদেশ কী করতে পারবে তা দেখার জন্য হয়তো ১ আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

এদিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল প্রথম দুই দফা আলোচনা শেষ করে গত সপ্তাহে দেশে ফিরেছে। আগামী সপ্তাহে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে শুল্ক ইস্যুতে তৃতীয় দফায় আলোচনার কথা রয়েছে। ১৬ জুলাই এ তৃতীয় দফা দরকষাকষি আলোচনার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দেশটির সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করতে একটি অবস্থানপত্র তৈরিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মতামত নিতে শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

১৬ জুলাই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানসহ খাদ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কৃষি, পররাষ্ট্রসহ ১১ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান উপস্থিত সাংবাদিকের বলেন, ‘আমদানি-রফতানির অনেক কিছুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জড়িত। তাদের সবার আবার নিজস্ব আইন রয়েছে। তাই আজ তাদের মতামত নিতেই এ বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে এখন নিয়মিত বৈঠক হবে। তারপর অবস্থানপত্র প্রস্তুত করে যুক্তরাষ্ট্রকে পাঠাব। তার ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হবে।’

মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ইস্যুটি বৈশ্বিক বিষয়। সারা বিশ্ব যে পদ্ধতি অনুসরণ করে, বাংলাদেশও তাই করছে।’ তবে তৃতীয় দফার আলোচনা বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট কোনো সময় দেয়নি জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘আমরা যোগাযোগ করছি।’

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবস্থানপত্র তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে ১৬ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে জুম প্লাটফর্মে মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। একইভাবে সাড়ে ৫টায় দেশটির আরেক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গেও বৈঠক হয়। ২২ জুলাই আমেরিকান অ্যাপারেলস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক ও বাণিজ্যবিষয়ক চুক্তির গোটা বিষয়টি বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবেলা করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের আরেকটু সিস্টেম্যাটিক হওয়া উচিত ছিল। কৌশলী হওয়া উচিত ছিল। সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু কোথায় যেন মনে হচ্ছে সেগুলো সুসংগঠিত ছিল না। প্রথমত, ডেজিগনেটেড লিড নেই। দরকষাকষিতে একেক সময় একেকজন গেছে। কাঠামোগত কোনো টেকনিক নেই আমলাদের মধ্যে বা আমলাদের বাইরে। তৃতীয়ত, এ শুল্ক ইস্যুতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বা সুবিধা পাওয়া অংশীজনরা বলেছেন তাদের সঙ্গে ন্যূনতম পরামর্শ করা হয়েছে এবং তা-ও করা হয়েছে দেরিতে।’

যুক্তরাষ্ট্র বা ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে পরিচালিত হয়, সেখানে লবিস্টদের কার্যকারিতা অনেক বেশি এমন তথ্য জানিয়ে মাশরুর রিয়াজ আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা লবিস্ট নিয়োগ করবে না। লবিস্ট নিয়োগ না দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বাণিজ্য সংগঠনের সদস্যদের সহযোগিতা হয়তো নেয়া যেত। কারণ এ সদস্যদের অনেকের বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো ব্যবসা রয়েছে। সেটাও নেয়া হয়নি। অর্থাৎ কৌশলের অভাব ছিল। পর্যায়ক্রমে দেখা যাচ্ছে পুরো বিষয়টি অনেক বেশি রাজনৈতিক। এখানে বাণিজ্যের ইস্যু কম, তার চেয়ে বেশি হলো সিকিউরিটি, ডিফেন্স। এগুলো বুঝতেও হয়তো দেরি হয়েছে। শুধু ট্যারিফ কমিয়ে এটার সমাধান হবে না—এ বাস্তবসম্মত অ্যাপ্রোচটা হয়তো আরো আগেই নেয়া উচিত ছিল।’

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে দরকষাকষিতে সব পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। মার্কিন শুল্ক মোকাবেলায় সরকারকে সহযোগিতা করতে গত মঙ্গলবার তিনি দলের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি প্রসঙ্গে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘চুক্তিটি নন-ডিসক্লোজার। সুতরাং সেনসিটিভ কিছু আছে কিনা আমরা জানি না। যদি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এমন কিছু বিষয় চুক্তিতে থাকে, সেক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করা উচিত। দিনশেষে রাজনৈতিক সরকারকেই কিন্তু দুই দেশের মধ্যে এ বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে।’

অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যদি ঐকমত্যে পৌঁছানো না যায় বা সম্মত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে ক্ষেত্রেও কি বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করবে—হোয়াটসঅ্যাপে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানকে এ প্রশ্ন করা হলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি তার ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ধরেননি।

আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মাদকবিরোধী অভিযানকালে ভিডিও করায় ‘অশালীন ভঙ্গি’, দুই পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে স্থানীয় লোকজন ভিডিও ধারণ করায় প...

সোহরাওয়ার্দীতে মিছিল নিয়ে যাচ্ছেন নেতা–কর্মীরা

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শনিবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে ‘জাতীয় সমাবেশ...

সমাবেশে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় উপজেলা জামায়াতের আমির নিহত

খুলনার দাকোপ উপজেলা জামায়াতের আমির আবু সাইদ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। শুক্রব...

গাজায় ইসরায়েলের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়: জার্মান চ্যান্সেলর

জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের সমালোচনা কর...

গোপালগঞ্জে কারফিউ আংশিক শিথিল

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে দফায় দফায় হামলা...

ইংল্যান্ডে তুমুল জনপ্রিয় সূর্যবংশী

ভারতের পুরুষ ও নারী জাতীয় ক্রিকেট দল ও অনূর্ধ্ব-১৯ দল একই সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর...

অবশেষে প্রেমে পড়লেন ৪২ বছরের ভার্জিন স্কুলশিক্ষক...

দেখার পর সিনেমাটির অনেকগুলো দৃশ্য চোখে ভাসতে থাকবে, তা নিশ্চিত। কফি হাউসের সা...

আগস্টে কলকাতায় নূরুজ্জামানের ‘মাস্তুল’

ভারতের ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কলকাতায় নির্বাচিত হয়েছে ঢাকার সিনেমা &lsquo...

দুই পেনাল্টি মিস করেও ইউরোর সেমিফাইনালে স্পেন

মেয়েদের ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে দুটি পেনাল্টি মিস করেও দারুণ এক জয় পেয়েছে স্প...

অন্যের স্ত্রী নিয়ে পার্কে ঘুরতে গিয়ে এসআই ক্লোজড

পার্কে অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়া বরিশাল মেট্রোপলিটন কা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা