র্যাপিড অ্যাকশন বাটালিয়নের (র্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহার রোধ ছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনী যেন পরবর্তী সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ার না হয়, তা নিশ্চিত করতে এ সুপারিশ করে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি। বাংলাদেশের সংস্কার নিয়ে এইচআরডব্লিউ এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টার্জিত অগ্রগতি ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্যই সংস্কার প্রয়োজন।
এইচআরডব্লিউর ৫০ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন আজ মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) প্রকাশিত হবে। গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বাংলাদেশে পদ্ধতিগত সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন: আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে সমালোচকদের দমনের জন্য ব্যবহৃত আটকাদেশ ও আইন বাতিলের অনুরোধ জানানো হয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথককরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশে সংস্কার নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারবিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা, পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন তৈরি–সংক্রান্ত সহায়তা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ২০০৪ সালে র্যাব গঠন করা হয়েছিল। এরপর যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা এই বাহিনীকে দায়মুক্তি দিয়ে কাজ করার অনুমতি দেয়। র্যাবের এক কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, গুম, হত্যা বা ক্রসফায়ারের ঘটনার জন্য র্যাবের একটি আলাদা দল রয়েছে। বেশির ভাগ কাজই ওই দল করে।
র্যাবে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালে তিনি র্যাবে যোগ দিয়ে হতবাক হয়েছিলেন। কারণ, একজন প্রশিক্ষক প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে তিনি ১৬৯টি ক্রসফায়ার পরিচালনা করেছেন।
রাজনৈতিক নেতারা যখনই ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তখন র্যাবের বিলুপ্তির বিষয়ে একমত পোষণ করেন। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মার্কিন সরকার র্যাবের পাশাপাশি বাহিনীর সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর তাদের প্রতিবেদনে র্যাবকে বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে। র্যাবপ্রধান এ কে এম শহীদুর রহমান ইউনিটের গোপন আটক কেন্দ্রের কথা স্বীকার করেন এবং বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ইউনিটটি বিলুপ্তি করে দিতে চাইলে র্যাব তা মেনে নেবে।
এমন প্রেক্ষাপটে এইচআরডব্লিউ জাতিসংঘ এবং দাতা সরকারকে সুপারিশ করে বলেছে, র্যাব বিলুপ্তি করা হবে শুধু এই শর্তেই যে র্যাবের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মকর্তা যাতে অন্য ইউনিটে গিয়ে একই অপকর্মের চর্চা করতে না পারেন, সে জন্য তাদের মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে এইচআরডব্লিউর জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীন করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাদের পদোন্নতি থেকে শুরু করে নিয়োগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। তার মতে, যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, র্যাবকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। র্যাবকে সংস্কার করা সম্ভব নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-অভ্যুত্থানের সময়ে নজিরবিহীন মাত্রায় দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। এ ধরনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত অনুশীলন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে দায়মুক্তির সংস্কৃতি উপভোগ করে আসছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি (সিএটি) বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। পুলিশসহ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়মুক্তি ও জবাবদিহি না থাকার বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর বহু থানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং প্রতিশোধের ভয়ে পুলিশ সদস্যরাও গা ঢাকা দিয়েছিলেন। যদিও মধ্য আগস্টের দিকে ৬৩৯ থানার মধ্যে ৬২৮টি আবার কার্যক্রম শুরু করে। এখন নিরাপত্তা খাতের সংস্কার এবং একই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ও সংস্কারের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। আর গুমের বিষয়টি তদন্তে কমিশনও গঠন করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে সংস্কারের পাশাপাশি পুলিশের সংস্কার নিয়ে আলাদা কমিশন গঠন করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আগে যে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল নিরাপত্তা বাহিনীগুলো, তা যাতে আর করতে না পারে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন ঢাকায় কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, শেখ হাসিনার আমলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যেভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে তাদের সংস্কার করা কঠিন হবে। এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীকে সংস্কার করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারি আইনজীবী ও বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নাগরিক সমাজের ওপর নজরদারি ও নিবর্তনমূলক চর্চা বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার নিশ্চিত করতে দাতাদেশগুলোর উচিত বিনিয়োগ করা। আর ভবিষ্যৎ সরকার ক্ষমতায় এসে যাতে এসব সংস্কারকে পাল্টে ফেলতে না পারে, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে একটি প্রস্তাব নেওয়া, যাতে তারা সংস্কার বাস্তবায়নে সহযোগিতার পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়ার পর কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি, না হলে পুলিশ তার আগের ধারায় ফিরে যাবে। এরই মধ্যে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর মামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গণগ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১০০ আওয়ামী লীগ নেতা এবং ২০০-৩০০ অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে পুলিশ যেকোনো মানুষকে হয়রানি করতে পারবে। কিছু অভিযোগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা জানেনই না কার বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করছেন।
এইচআরডব্লিউর গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার ঢাকায় কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার মানবাধিকার ও বাক্স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এই প্রতিশ্রুতির বিপরীত আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। ১৬০ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়েছে এবং অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এ আইন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে আগের সরকার বাংলাদেশে ব্যবহার করেছিল।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিতর্কের বিষয়ে জুলিয়া ব্লেকনার রাবিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বিবৃতি দেখেছি, যেখানে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি তোলা হয়েছে, এটি বেশ উদ্বেগের। কারণ, বাংলাদেশিরা হয়তো আরেকটি নির্বাচন পেতে যাচ্ছেন, যেখানে তারা পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারবেন না।’ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, জানতে চাইলে জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, সঠিক উপায়ে তদন্ত করে অভিযোগ গঠন করে বিচার করা।
প্রতিবেদনে টেকসই সংস্কারের সুপারিশের মধ্যে আরো বলা হয়েছে, গণগ্রেপ্তার ও অজ্ঞাতনামা মামলা বন্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। আটক ব্যক্তিদের যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারকের সামনে হাজির করা যায়। আটকে রাখার স্থান যাতে পরিদর্শন করা যায়। সেই সঙ্গে রিমান্ডের প্রচলনে নিষেধাজ্ঞা আনতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সাংবাদিকদের রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, রিমান্ডে নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতন করে থাকে। এ ছাড়া যেসব আইন জবাবদিহির পথে বাধা, এসব আইন সংশোধন বা বাতিল করার পরামর্শ অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরও (আইসিটি) সমালোচনা করা হয়েছে। অতীতে এটিকে ব্যবহার করে অস্বচ্ছ বিচার করা হয়েছে। আইসিটির এখনো অনেক ধারাই আন্তর্জাতিক মানের নয়। এখানে এখনো মৃত্যুদণ্ডের মতো বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় এমন ধারা রয়েছে, যেমন অনুপস্থিতিতে বিচার করা। নভেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে শেখ হাসিনাসহ ৮০ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে জুলিয়া ব্লেকনার সাংবাদিকদের বলেন, আইসিটিতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানো সহজ হবে না। বাংলাদেশ আইসিটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করলে, মৃতুদণ্ডের বিধান বাতিল করলে ভারতকে চাপ দেওয়া আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য সহজ হবে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            