ছবি: সংগৃহীত
জাতীয়
সাবেক আইজিপির জবানবন্দি

গণভবনই থেকে এসেছিল হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও ব্লক রেইডের সিদ্ধান্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই মাসে ঢাকায় সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারী ছাত্র ও জনতার ওপর গুলি চালানো হয়েছিল বলে দাবি করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি জবানবন্দিতে জানান, আন্দোলন দমনে প্রতিদিন রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হতো। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা করা হয়। অভিযানে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ এসেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে—এমনটিও দাবি করেন তিনি।

এই তথ্যগুলো উঠে এসেছে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দেওয়া একটি জবানবন্দিতে। গত ২৪ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় জবানবন্দি দেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। মামলার নথিতে থাকা তাঁর বক্তব্যের বিস্তারিত তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে।


২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগেই ব্যালট বাক্স ভর্তি, গুম, গোপন আটক কেন্দ্র এবং আন্দোলন দমনের নানা কৌশল জবানবন্দিতে তুলে ধরেছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তেই এসব অভিযান পরিচালিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। ২০২২ সাল থেকে বর্তমান সরকারের পতন পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এর আগে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধসংক্রান্ত এক মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করা হয়নি বলে দাবি করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাঁর দেওয়া জবানবন্দিতে বলা হয়, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশেই মাঠপর্যায়ে পুলিশ কার্যক্রম চালায়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় করতে নির্দেশনা দিতেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ওবায়দুল কাদের এবং জাহাঙ্গীর কবির নানক।

জবানবন্দিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হেলিকপ্টার ব্যবহার, নজরদারি এবং গুলি চালানোর পরিকল্পনা গোপনে নেওয়া হয়। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, এই পরিকল্পনায় র‍্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশীদের ভূমিকা ছিল এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার মোতায়েন ও অভিযান পরিচালিত হয়। তবে তিনি নিজে, আইজিপি হিসেবে, এসব অভিযানে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন না বলে দাবি করেন। তাঁর ভাষায়, ‘মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই হেলিকপ্টার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আসে।’

প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে সেখানে ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা ও সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাজনৈতিকভাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাঁকে জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই এমন সিদ্ধান্ত হয়। এই বৈঠকে অতিরিক্ত ডিআইজি (হেডকোয়ার্টার) প্রলয় জোয়ারদার উপস্থিত ছিলেন, যিনি পরবর্তীতে পুলিশ কর্মকর্তাদের ওই নির্দেশনা জানান।

জবানবন্দিতে আরও দাবি করা হয়, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ ছিল এবং তিনিসহ ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদ আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন যেকোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে। ১৮ জুলাই (২০২৪) ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চায়নিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে জবানবন্দিতে বলা হয়, সেখানে পুলিশ সঠিক ভূমিকা পালন করেনি। মূলত ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে পুলিশ কাজ করে। ওবায়দুল কাদের ও নানক সাহেব ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নির্দেশনা দিতেন। তাঁরাসহ কিছু নেতা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেন।

সরকারকে বিপথে পরিচালিত করে ও আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পুলিশ অফিসার সবাই আগ্রহী ছিলেন। ওবায়দুল কাদেরের আগ্রাসী বক্তব্যের ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে যায়।

বৈঠকে স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর সাহেব, অতিরিক্ত সচিব রাজনৈতিক টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তাফা, এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবির প্রধান হারুন উর রশীদ, র‍্যাবের ডিজি হারুন অর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, বিজিবির ডিজি ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান উপস্থিত থাকতেন।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক হতো বলে জানান সাবেক আইজিপি। রাত ৮টা, ৯টার দিকে এ বৈঠক হতো। তিনি সদস্য হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকতেন।

জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি মামুন বলেন, ‘বৈঠকে স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর সাহেব, অতিরিক্ত সচিব রাজনৈতিক টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তাফা, এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবির প্রধান হারুন উর রশীদ, র‍্যাবের ডিজি হারুন অর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, বিজিবির ডিজি ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান উপস্থিত থাকতেন। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা জানাতেন এবং পরামর্শ করতেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় কোর কমিটির এমন এক বৈঠক থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়দের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এটা উল্লেখ করে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি মামুন বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আটকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিজিএফআই এবং ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে। পরে তাঁদের (সমন্বয়কদের) আটক করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয় এবং সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতনসহ চাপ দেওয়া হয়। তাঁদের আত্মীয়স্বজনকেও নিয়ে আসা হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য টেলিভিশনে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়।’

জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘কোর কমিটির বৈঠকে তাদের আটকের বিষয়ে আমি বিরোধিতা করি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তাদের আটক করা হয়। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামালের গভীর সম্পর্ক ছিল। আসাদুজ্জামান খান কামাল হারুনকে “জিন’’ নামে ডাকতেন। তিনি হারুনকে খুব কর্মতৎপর এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে খুব কার্যকর মনে করতেন।’

এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় অফিশিয়াল বৈঠকবহির্ভূত হিসেবে কতিপয় পুলিশ অফিসার, ওসি, এনটিএমসির তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের তৎকালীন ডিজি এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন বলেও জবানবন্দিতে এসেছে।

জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘৪ আগস্ট রাতে হঠাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। গণভবনে রাত ১০টার দিকে বৈঠক হয়।
৪ আগস্ট শেখ হাসিনার দুই বৈঠক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগের দিন ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট গণভবনে শেখ হাসিনা দুই দফা বৈঠক করেছিলেন বলে সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়।

সেখানে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন বাহিনীর প্রধান এবং আমিসহ নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। আন্দোলন পরিস্থিতি এবং তা দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায়, আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সরকারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিংয়ে থাকাবাস্থায় পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে ও বিভিন্ন স্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।’

দ্বিতীয় বৈঠকের বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘৪ আগস্ট রাতে হঠাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। গণভবনে রাত ১০টার দিকে বৈঠক হয়।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর বোন শেখ রেহানা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রধান, র‍্যাবের ডিজি এবং আইজি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। জেনারেল মুজিব (লে. জেনারেল মুজিবুর রহমান) উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। সেখানে খোলামেলা কথা হয়। এসবির প্রধান মনিরুল ও ডিজিএফআইয়ের ডিজি বাইরে ছিলেন।’

৪ আগস্টের ওই বৈঠকে কীভাবে পরদিনের অর্থাৎ ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয় জানিয়ে সাবেক আইজিপি জবানবন্দিতে বলেন, ‘ওই বৈঠকে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক ৩০-৪৫ মিনিট হয়। বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, র‍্যাবের ডিজি, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, আমি নিজে ছিলাম। সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২টায় শেষ হয়। বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। পুলিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।’

র‍্যাবের সাবেক এই মহাপরিচালকের জবানবন্দিতে উঠে আসে, ‘কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক (শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা) সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন।’


সাবেক আইজিপি মামুনের জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে আমাদের (পুলিশ) শক্ত অবস্থান ছিল। ঢাকার প্রবেশমুখে উত্তরা-যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অবস্থান গ্রহণ করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ অফিসাররা ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা নির্দেশনা প্রদান করেন।’

ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘বেলা ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি যে সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠপর্যায়ের অফিসার ও ফোর্স আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এর ফলে গণভবনমুখী জনস্রোতকে দমন ও আটকানো সম্ভব হয়নি। বেলা একটার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিএমও (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) থেকে আমাদের বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকানোর জন্য। আমি ৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বুঝতে পারি যে সরকারের পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারত যাবেন কি না, তা জানতে পারিনি। সেনাবাহিনী তা জানায়নি।’

জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল বেলায় জানতে পারি পুলিশ অফিসারদের নেওয়ার জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হেলিকপ্টার আসবে। আমি উক্ত হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাই এবং সেখান থেকে সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে আশ্রয় গ্রহণ করি।’


২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন রাতের ভোট হিসেবে পরিচিত। এই নির্বাচনের আগের রাতেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যালট বাক্স ভরে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন সাবেক এই আইজিপি। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত ছিলাম।

তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাতের বেলায় ব্যালট বাক্সে প্রায় ৫০ শতাংশের মতো ব্যালট পেপার ভরে রাখার পরামর্শ দেন বলে শুনেছি। মাঠপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে রাতে ব্যালট বাক্সে ভোট দেওয়ার (ব্যালটে সিল মেরে ভরে রাখা) ব্যাপারে নির্দেশনা প্রেরণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় ও উদ্যোগে জেলা প্রশাসন, ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, এসপি ও থানার ওসিগণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে পুলিশের বিপিএম ও পিপিএম পদক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচনসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় পুলিশ অফিসারদের বিবেচনা করা হতো। এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পেশাদারত্ব দেখানো হয় নাই।’


২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে র‍্যাবে গুম ও গোপন বন্দিশালার বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতাও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন সাবেক আইজিপি মামুন। তিনি বলেন, ‘র‍্যাবের মহাপরিচালক থাকার কারণে আমি জানি যে টিএফআই সেল র‍্যাবের সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত হতো। এটির অবস্থান হলো উত্তরার র‍্যাব-১-এর কম্পাউন্ডের ভেতরে। এ ছাড়া র‍্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের অধীনেও আলাদা আলাদা সেল বা বন্দিশালা ছিল। যেগুলো সংশ্লিষ্ট র‍্যাব ইউনিটগুলোর প্রধানদের অধীনে পরিচালিত হতো।’

তিনি বলেন, ‘র‍্যাবের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন এবং গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র‍্যাবের ভেতরে একটা কালচার (সংস্কৃতি) হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এই কাজগুলো প্রধানত র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি, অপারেশনস) এবং র‍্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকেরা সমন্বয় করতেন।’

র‍্যাবে কাজ করা পুলিশের সাবেক এই প্রধান জবানবন্দিতে বলেন, ‘র‍্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা বা গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এ ধরনের আদেশ পাই নাই। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের পক্ষ থেকে আসত বলে জানতে পারি। র‍্যাব যদিও আইজিপির অধীনে ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড মানা হতো না। র‍্যাবের প্রধানেরা আইজিপিকে উপেক্ষা করেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে কাজ করত।’

দীর্ঘদিন গুম থাকা ব্যারিস্টার আরমানের বিষয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, ‘টিএফআই সেলে কতজন বন্দী আসত বা কারাবন্দী আছে, এসব বিষয়ে সবকিছু আমাকে জানানো হতো না। এ বিষয়গুলো র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক দেখভাল করতেন। ব্যারিস্টার আরমান টিএফআই সেলে বন্দী আছেন, এ বিষয়টি আমি জানতাম। তবে তাঁকে আমার সময় তুলে আনা হয়নি। অনেক আগে তুলে আনা হয়। র‍্যাবের আমার পূর্ববর্তী ডিজি বেনজির আহমেদ (সাবেক আইজিপি) দায়িত্ব হস্তান্তরকালে ব্যারিস্টার আরমান যে টিএফআইতে আটক আছেন, তা আমাকে অবহিত করেন।’

র‍্যাবের সাবেক এই মহাপরিচালকের জবানবন্দিতে উঠে আসে, ‘কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক (শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা) সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন।’

জবানবন্দিতে আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘আমি র‍্যাবের দায়িত্ব পালনকালে টিএফআই সেলে বিনা বিচারে বন্দীদের আটক রাখা এবং নির্যাতন করা বা কাউকে কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার কিছু কিছু বিষয় জানতাম। কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। কারণ, এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য বাহিনীর এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আসত এবং তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করত। এমনকি (পরে) পুলিশপ্রধান হয়েও আমি র‍্যাবের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি বা করতে পারিনি।’
ক্ষমা প্রার্থনা

পাঁচ পৃষ্ঠার জবানবন্দি শেষে সাবেক আইজিপি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনায় এবং অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসার ও পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং জনগণের ওপর গুলি করাসহ নির্বিচার নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করায় সাবেক পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আমার ভূমিকাসহ সার্বিক চিত্র বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে এই জবানবন্দি প্রদান করলাম।’

আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ই-সিগারেট উৎপাদন নিষিদ্ধের নির্দেশনায় সরকারের প্রতি বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের কৃতজ্ঞতা

দেশে ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ENDS) উৎপাদনের অনুমতি...

বুবলীর চমক,অন্য রকম জীবন

গানচিল মিউজিকের নতুন প্রজেক্ট ‘বাংলা অরিজিনালস’ শুরু হলো ‘ম...

ডুবে গেছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু

টানা বৃষ্টি ও আর পাহাড়ি ঢলে কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়ায় ডুবে গেছে রাঙামাটির আইক...

রাশিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প, একাধিক দেশে সুনামি সতর্কতা

রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের কামচাটকা অঞ্চলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘা...

সাবেক দুই জেলা প্রশাসকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতু রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া...

ইউনূস সরকারের নিরাপদ প্রস্থানের সময় ফুরিয়ে আসছে

অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সময় ফুরিয়ে আসছে...

ভৌতিক গল্প নিয়ে কানাডায় নুহাশ

হরর, অতিপ্রাকৃত, ফ্যান্টাসি ঘরানার সিনেমা নিয়েই মূলত কানাডার ফ্যান্টাজিয়া আন্...

এক সিদ্ধান্তেই বদলে গেল জীবনটা

২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘মাসান’। সমালোচকপ্রিয় ও বহুল প্রশংসিত এ...

ফিরেই দলকে নাটকীয় জয় এনে দিলেন মেসি

এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরেই পুরোনো চেহারায় দেখা গেল লিওনেল মেসিকে। বাং...

নাঈম এবার অস্ট্রেলিয়া সফরে

বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট বাদ দিলে বাংলাদেশ শেষবার অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ খেলেছে ২০০৮ স...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা