সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এবং বাইরে রয়েছে ৫৪টি নদী। এসব নদীর নাব্যতা অনেক কমে গেছে এবং নদীতে প্লাস্টিক ও পলিথিন জমে থাকায় মৎস্যসম্পদ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি নদী খননকাজও জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাভারেজ ইন্টারন্যাশনাল বলছে, প্রতিবছর এই ৫৪টি নদীতে মোট ১৮ হাজার ১১৮ টন (৫০ টন প্রতিদিন) প্লাস্টিক ঢুকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং মানুষ উভয়ই ঝুঁকিতে পড়ছে।
এনভায়রনমেন্ট ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ব্যুরো জানায়, জোয়ার–ভাটার স্রোত ধরে সুন্দরবনের আশপাশের অর্ধশতাধিক গ্রাম থেকে তোয়ালে, চিপসের প্যাকেট, লবণের প্যাকেট, লাউগাছসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক ভেসে এসে সুন্দরবনে ঢুকে পড়ে। এছাড়া সুন্দরবনে আসা পর্যটক, জেলে ও বনজীবীরাও বিভিন্ন আবর্জনা ফেলে রেখে যান।
সুন্দরবন অঞ্চলে যেসব স্থানে মানুষের উপস্থিতি বেশি, সেসব স্থানে প্লাস্টিক দূষণ বেশি দেখা যায়। জেলে ও নৌকায় চলাচলকারী ব্যক্তিরা পানির বোতল, চিপসের মোড়ক, পলিথিন, প্লাস্টিক থালা-বাটি, চায়ের কাপ, পানির বোতল নদীতে বা বনে ফেলে দেন।
জলবায়ু পরিবর্তন, নৌযান চলাচল, বনজীবী, পর্যটক, নৌযানের জেটি এলাকা, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলা শতাধিক বড় নৌযান থেকে বর্জ্য ফেলা—সব মিলিয়ে প্লাস্টিক দূষণ বাড়ছে।
গবেষণায় দেখা যায়—সুন্দরবনের তিনটি মূল নদীর ২১টি অংশে ৩২টি জায়গায় ৩৬ দিন ধরে পরীক্ষায় ১৭ প্রজাতির মাছ, তিন প্রজাতির শেলফিশে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মাছের শরীরে ৫ থেকে ১০০ মাইক্রোমিটার সাইজের বায়োফিল্মসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় মাছের দেহে পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে খাদ্যের মাধ্যমে। এর গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে হরমোনের সমস্যা, প্রজননক্ষমতা হ্রাস, মাতৃদুগ্ধে মাইক্রোপ্লাস্টিক, কিডনি-ক্যান্সারের ঝুঁকি ইত্যাদি।
পলিথিন ও প্লাস্টিক ডাস্টবিন, ড্রেন হয়ে সময়ের সাথে নদীতে গিয়ে পড়ে। নদীতে এটি তলদেশে জমা হয়, নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, নাব্যতা কমায়। ড্রেনে পলিথিন দ্রবীভূত না হওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
প্লাস্টিক পোড়ালে ক্ষতিকর গ্যাস এবং ধুলিকণা উৎপন্ন হয়, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়াও নদীতে জমে থাকা প্লাস্টিক অপসারণ করতে দেশীয় জাল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকার পলিথিন নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। সারাদেশে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চলছে। ৩ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ১৯৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ২৫ লাখ ৭০ হাজার ২০০ টাকা। জব্দ করা হয়েছে ৫০ হাজার ৫৫২.৩ কেজি পলিথিন। পাশাপাশি চারটি কারখানা পরিদর্শন ও সিলগালা করা হয়।
কাঁচাবাজার ও সুপার মার্কেটে পলিথিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভা, পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যাগ প্রচার, ই-প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন চুক্তি ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
প্লাস্টিক দূষণ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে। সোনালি ব্যাগসহ বিকল্প ব্যাগ ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
প্লাস্টিক সাধারণত ভূমি থেকে নদীতে আসে এবং নদীপথেই সমুদ্রে যায়। আর সমুদ্রে যেসব প্লাস্টিক মাছ খায়, তা মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে।
মাছের ১৪টি প্রজাতির পরীক্ষা করে দেখা যায় সুন্দরবন সন্নিহিত নদীর মাছগুলোর পেটে ০.৪ থেকে ৭ পিক্সেল পর্যন্ত প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মানে এক গ্রাম খাবারে ০ থেকে ৭ পিক্সেল পর্যন্ত প্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করছে।
এর ক্ষতি হচ্ছে পাচনতন্ত্র, লিভার–কিডনি, হরমোন সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি।
পানির পাশাপাশি লবণে, চিনিতে, শাকসবজিতেও এখন মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে।
লবণ অধিকাংশ ঘরে ব্যবহার করা হয় সেখানে প্লাস্টিক থাকলে এটি শরীরে প্রবেশ করছে।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক দ্রুত বেড়ে চলেছে। অনেক পণ্য চিপস, নুডুলস, লবণ, চিনি একবারের প্লাস্টিক মোড়কে বিক্রি হয়।
এ ছাড়া গ্রামেও ব্যাপক হারে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক মানুষের চিন্তা-চেতনাসহ জীবনযাত্রার সাথে যুক্ত হয়েছে।
আমারবাঙলা/এসএ