নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ১৫ বছরে সড়ক ও মহাসড়কের ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও, দেশটি একটি ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি: পরিবহণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে সড়কগুলো ক্রমেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। দেশে নতুন রাস্তা বা লেন তৈরি করার সময় মৌলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবহেলিত থাকে। সাথে যোগ হয় লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি। এতে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার জীবন সড়কে ঝড়ে যায়। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) স্বীকার করেছে যে প্রায় ৬ লাখ নিবন্ধিত যানবাহনে মেয়াদোত্তীর্ণ রুট পারমিট নিয়ে চলাচল করছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।
টিআইবি বলছে, দেশে প্রায় ২০% বাস নিবন্ধন ছাড়াই চলে এবং মাত্র এক চতুর্থাংশকে রাস্তার চলার উপযুক্ত। খোদ রাজধানীতেই কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে বেপরোয়াভাবে বাসগুলো একে অপরের সাথে রেস করছে, দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে সারাদেশের মহাসড়কগুলোও অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। এক রুটে অনুমোদিত যানবাহন অন্য রুটে চলছে অবৈধভাবে। দীর্ঘকাল ধরে, বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে চলাচলকারী যাত্রী এবং পথচারীরা কীভাবে রাস্তাগুলিকে নিরাপদ করা যায় এবং এটি করার জন্য কার দায়বদ্ধতা রয়েছে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে, তবে এই প্রশ্নের উত্তরগুলি অবিশ্বাস্যভাবে জটিল এবং অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে। এদিকে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।
সড়ক পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অযোগ্য যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন চালক, অ্যানালগ ট্র্যাফিক ব্যবস্থা, ঘুষ, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, পর্যাপ্ত বাস টার্মিনালের অভাব, অবৈধ পার্কিং, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, গণপরিবহনে সংকট, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং আইন মানার মানসিকতা উল্লেখযোগ্য ভাবে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ট্র্যাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ন্যাশনাল রোড সেফটি কাউন্সিল (এনআরএসসি), এবং জেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি এই বিষয়গুলো দেখাশোনার জন্য দায়ী, কিন্তু তাদের ভূমিকা এসব বিষয়ে সন্তোষজনক নয়। সমাধান পাওয়া গেলেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না।
সড়ক পরিবহণ বিশেষজ্ঞদে মতে, আমরা সড়ক-মহাসড়ক এবং পরিবহণ ব্যবস্থা এতটাই এলোমেলো করে ফেলেছি যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেক কাজ করতে হবে। শুধু কাগজে কলমে উদ্যোগ নিলে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসবে না। সড়ক-মহাসড়ক অনেক উন্নত হয়েছে কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়নি। রাস্তায় সব ধরনের অব্যবস্থাপনা আছে। চালকদের দোষ না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব নিতে হবে। মহাসড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শতভাগ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা প্রয়োজন, কিন্তু আছে মাত্র ৫%। সিস্টেমের ৯৫% অবৈজ্ঞানিক। তদন্ত কমিটি গঠনে পরিবর্তন আনতে হবে। একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন হওয়া উচিত।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৫৯ লাখ ৮২ হাজার। রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ, যার মধ্যে ফিটনেস নেই প্রায় ৬ লাখের। একই সঙ্গে এসব গাড়ির অধিকাংশের রুট পারমিটের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। তবে মোট নিবন্ধিত যানবাহনের ৩০% থেকে ৪০% আর রাস্তায় চলছে না। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে চলাচলকারী ১৮.৯% বাসের নিবন্ধন নেই, আর ফিট মাত্র ২৪% বাস, ১৮.৫% বাসে ট্যাক্স টোকেন নেই এবং ২২% বাসের রুট পারমিট নেই। বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত ৬৪টি জেলার সড়কে বিআরটিএর অভিযান চলছে। এসব অভিযানে অবৈধ যানবাহনকে বেশি জরিমানা করা হচ্ছে। এতে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে রাস্তায় শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা হবে। সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সবার। যাত্রী ও পথচারীদেরও দায়িত্ব আছে। এজন্য আমরা সামাজিক আন্দোলনের দিকে এগুচ্ছি। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বর্তমানে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২,৪৭৬ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৭ লাখ কিমি। সারাদেশে সড়ক সম্প্রসারণের পাশাপাশি যানবাহন চলাচল ও গতিও বেড়েছে, কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণ ও যানবাহন মনিটরিংয়ের প্রযুক্তি অনেকাংশে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়ত যানবাহনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে, দুর্ঘটনা ঘটছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫,২১১ জন, ২০২০ সালে ৫,৪৩১ জন, ২০২১ সালে ৬,২৮৪ জন, ২০২২ সালে ৭,৭১৩ জন এবং ২০২৩ সালে ৬,৫২৪ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এক হাজার ৪৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৩৬৭ জন নিহত ও এক হাজার ৭৭৮ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে শুধুমাত্র ঈদযাত্রায় (৪ থেকে ১৮ এপ্রিল) সড়ক, রেল ও নৌ দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত, আহত হয়েছে এক হাজার ৪২৪ জন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান বলেন, ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত গতি। প্রতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের উপরে গাড়ির গতি প্রতি ৫ কিমি বাড়লে দুর্ঘটনার ঝুঁকি দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যায়। দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্য কারণগুলো হলো ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, চালকদের অদক্ষতা এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। তাছাড়া চালকদের অনির্ধারিত বেতন ও কর্মঘণ্টা, মহাসড়কে কম গতির যানবাহন, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, ট্র্যাফিক আইন না শেখার ও না মানার প্রবণতা এবং বিআরটিএর সক্ষমতার অভাব।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরি বলেন, “ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ সড়ক পরিবহণ খাত থেকে চাঁদাবাজি করছে। পরিবহণ খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। দেশে সড়ক নিরাপত্তা ইস্যুতে এখনো বিভিন্ন কমিটি গঠন ও সুপারিশ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় আমলা ও পরিবহণ নেতারা দায়ী। বর্তমানে সড়কের অবস্থা দেখে বোঝা যায় দেশে সড়ক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। টিআইবির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস কোম্পানির মালিক ও পরিচালকদের প্রায় ৯২% রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত - ৮০% ক্ষমতাসীন দলের সাথে এবং ১২% অন্যান্য দলের সাথে। ফলে গণপরিবহন ব্যবস্থা যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠবে বলে মানুষ যতই আশা করুক না কেন, বাস্তবে তা মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনের কাছে জিম্মি থেকে যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, কিছু মালিক তাদের যানবাহন মেরামত করতে অনীহা দেখাচ্ছেন। আমরা এসব গাড়ির মালিকদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই। আমরা ধর্মঘটে যাব না। আমরা সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করছি না।
২০১৮ সালে নজিরবিহীন ছাত্র আন্দোলনের পর, ট্র্যাফিক নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য কঠোর শাস্তি সহ একটি আইন পাস করা হয়েছিল। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি ১১১টি সুপারিশ পেশ করেছে। সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে এর কোনোটিই সড়কে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যানবাহনের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হলেও পরিবহণ নেতাদের চাপের কারণে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলে বাধা দিতে তা কার্যকর করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এ খাতের সঙ্গে জড়িতরা। বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনের একটা বড় দায়িত্ব আছে। বিআরটিএও দায়ী। সর্বোপরি সরকার দায়ী। সড়ক পরিবহণ আইনে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার রাখতে পারছে না। সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ভালো রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। চার লেন ও সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হচ্ছে। বাঁক সোজা করা হয়েছে. হাইওয়ে পুলিশ তদারকি করছে। বিআরটিএ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সুতরাং, আমাদের বলা উচিত নয় যে আমাদের কোন অর্জন নেই, তবে আমাদের মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।”
এবি/ এইচএন
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            