শিল্পকলা একাডেমির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ। গতকাল শনিবার রাজধানীতে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় একদল ব্যক্তির বিক্ষোভের মুখে ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করতে বাধ্য হন আয়োজকেরা। এদিন বিক্ষোভকারীদের বাধার মুখে নাটকটি শুরু হলেও পরের দফায় ফটকের বাইরে তাঁরা প্রতিবাদ করলে একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ নাট্যদল ‘দেশ নাটক’–এর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার মুখে পড়ে শিল্পকলা একাডেমি। এরপর আজ রোববার সকালে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসে নাটক বন্ধের কারণ, ওই সময়ের পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে কথা বলেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক।
সৈয়দ জামিল আহমেদ জানান, দর্শকের ‘নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। পরিস্থিতি দেখে তাঁর শঙ্কা হয়েছিল, শিল্পকলা একাডেমিও ‘আক্রান্ত হতে পারে’।
সৈয়দ জামিল আহমেদের ভাষ্যে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ২২ জায়গায় শিল্পকলা একাডেমিতে হামলা হয়েছে। সেসব মাথায় ছিল। আর এখানে ভেতরে দর্শক ছিল। উত্তেজিত কেউ গিয়ে যদি দর্শকদেরও আক্রমণ করে বসে; দর্শকের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা প্রদর্শনী বন্ধ করি। আমি ভেতরে গিয়ে দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।’
ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বিকেল থেকে নাটকের টিকিট বিক্রি শুরু হয়। এরপর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে একদল লোক শিল্পকলার গেটের সামনে দেশ নাটকের সদস্য এহসানুল আজিজ বাবুকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
পরে একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করলে যথারীতি নাটকের প্রদর্শনী শুরু হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা আবার সংগঠিত হয়ে নাট্যশালার ফটকের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁরা ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে মহাপরিচালক দেশ নাটকের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
ঘটনার বর্ণনা করে জামিল আহমেদ বলেন, ‘শিল্পকলার আয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে যাত্রা উৎসব চলছে। আমি এবং নাট্যকলা বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির সেখানে ছিলাম। নাট্যশালার সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে শুনে আমি যাই। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা বলেন, এহসানুল আজিজ বাবু স্বৈরাচারের দোসর। তাঁর নাট্যদলের প্রদর্শনী করতে দেবেন না। আমি তাঁদের বুঝিয়েছি, দেশ নাটকের জনা বিশেক সদস্যও জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুথানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধও আছেন।’
ঘটনার বর্ণনায় জামিল আহমেদ আরও বলেন, ‘প্রথমে তাঁরা মেনে নেন; আমরা নাটকের প্রদর্শনী শুরু করতে বলি। কিন্তু পরে আবার বিক্ষোভ শুরু করেন; তাঁরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন।’
শিল্পকলা একাডেমি ‘আক্রান্ত হওয়ার’ শঙ্কা তৈরি হয়েছিল মন্তব্য করে জামিল আহমেদ বলেন, ‘আমি এটাও বলেছি, আমার বুকের ওপর দিয়ে যান। তখন আমাকে পাশ কাটিয়ে দেয়াল টপকে কয়েকজন ঢুকে পড়েন। যখন গেট ভেঙে ফেলেন, তখন আমরা দেশ নাটকের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা না নেওয়ার কারণেও সমালোচনার মুখে পড়ে শিল্পকলা একাডেমি। এ ঘটনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা কেন নেওয়া হলো না—এ প্রশ্নে জামিল আহমেদ বলেন, ‘মাত্র কিছুদিন আগেই গুলি চলেছে। আমরা আর দমন–পীড়ন চাইনি। সেখানে বিক্ষোভ করতে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যেও দুজন ছিলেন জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় নয়, জনগণের আন্তরিক চেষ্টায় একটি ‘জনবান্ধব শিল্পকলা একাডেমি’ গড়ে তোলার প্রত্যাশাও রেখেছেন এই অধ্যাপক।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, ‘গতকাল আমি একটা খণ্ডযুদ্ধ করেছি। অনেক চেষ্টা করেছি, নাটকের প্রদর্শনী যেন হয়। কিন্তু আমি হেরে গেছি। একটা খণ্ডযুদ্ধে হেরে গেছি। কিন্তু মূল যুদ্ধটায় এখনো হারিনি।’
একাডেমির ভেতরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করলেও তাঁদের সহযোগিতা কেন নেওয়া হয়নি, তা জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্নে তুলে জামিল আহমেদ বলেন, ‘বলপ্রয়োগে থামাবেন? নাকি কথা দিয়ে থামাবেন? এখানে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের কষ্টের কথা বলেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক ছিল? আমি মনে করেছি, এটা সেনাবাহিনীর জায়গা নয়।’
শেষের দিকে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা সেখানে এসেছিলেন এবং সেনাবাহিনীর দুটি গাড়িও এসেছিল বলে জানান জামিল আহমেদ। মহাপরিচালক বলেন, সেনাবাহিনীকে জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চাননি তিনি।
গত ১৭ অক্টোবর নাট্যদল দেশ নাটকের এহসানুল আজিজ বাবু তাঁর ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লেখেন, ‘আসুন আমরা সবাই এই দেশকে বাঁচাই, জয় বাংলা বলে এই বাংলাদেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।’
পোস্টের সঙ্গে একটি ছবিও শেয়ার করেন বাবু, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের ছবি ‘এডিট করে জিন্নাহ টুপি পরানো হয়েছে’ এবং তাঁদের ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। ওই পোস্ট ঘিরেই কিছু মানুষ জাতীয় নাট্যশালার সামনে আসেন বলে জামিল আহমেদের ভাষ্য।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, ‘যে পোস্ট করা হয়েছিল, সেটি অত্যন্ত নিম্নরুচির। এটি বাবুকেও আমি বলেছি। আমি তাঁকে বলেছি, এভাবে নিম্নরুচির পোস্ট ফেসবুকে না লিখে যুক্তি দিয়ে নাটক করুন। নাটকের মধ্য দিয়ে সরকারের সমালোচনা করুন।’
শিল্পকলাকে জনগণকেই বাঁচাতে হবে বলে মনে করেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। শিল্পকলাকে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ার স্বপ্নের কথাও বলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘জনগণকেই শিল্পকলার দায়িত্ব নিতে হবে। সেনাবাহিনীর পাহারায় নয়; জনগণই যেন শিল্পকলাকে রক্ষা করে। আমরা এমন জনবান্ধব শিল্পকলা চাই।’
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            