চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততা আর কোলাহলকে ছাপিয়ে এক টুকরো আশা ছড়িয়ে দিচ্ছে ‘নগরফুল হলিডে স্কুল’। বিলাসবহুল কোনো ভবনে নয়, পার্ক, রেলস্টেশন কিংবা ফুটপাতের এক কোণে বসেই চলছে এই বিশেষ স্কুল। এখানে পড়তে আসা সব শিক্ষার্থীই পথশিশু—যাদের ছিল না স্থায়ী ঠিকানা, নিয়মিত খাবার কিংবা কোনো স্বপ্ন।
তাদের সেই স্বপ্নহীন জীবনেই আলোর বীজ বুনে চলেছেন একদল তরুণ।
স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা তরুণ সমাজকর্মী তাসনীম হোসেন। তিনি বলেন, "আমরা চেয়েছি শিশুদের মনে এই বার্তাটা পৌঁছে দিতে—তাদের জীবনেও পরিবর্তন আসতে পারে। তারাও একদিন ডাক্তার, শিক্ষক, পুলিশ কিংবা শিল্পী হতে পারে।"
২০১৮ সালে মাত্র পাঁচজন শিশুকে নিয়ে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল। তখন অনেকেই এই ছোট প্রচেষ্টার সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। আজ ‘নগরফুলে’ নিয়মিত প্রায় এক শর বেশি শিশুর অংশগ্রহণ রয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন ছুটির সময়গুলোতে চলে এই ‘হলিডে স্কুল’।
শিক্ষাদানের পদ্ধতিও একেবারেই গতানুগতিক নয়। পাঠ্যবইয়ের শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা, পরিচ্ছন্নতা, চিত্রাঙ্কন, গান, নাচ ও থিয়েটারের মতো সৃজনশীল বিষয় শেখানো হয়। এ ছাড়া শিশুদের নিয়ে আয়োজন করা হয় স্বাস্থ্য শিবির, বইমেলা বা ঈদ-পূজা উৎসব। এটি যেন শুধু একটি স্কুল নয়, বরং একটি বিকল্প পরিবার।
স্কুলটির অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন জানান, “প্রথমে আমরা ওদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য অনেক সময় দিয়েছি। কারণ রাস্তায় বেড়ে ওঠা এই শিশুরা মানুষের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এখন ওরাই আমাদের স্কুলে আসতে না পারলে মন খারাপ করে, কাঁদে।”
এই স্কুলের অন্যতম বড় অর্জন হলো কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মূলধারার বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাত এখন স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। তার মা একসময় তাকে ভিক্ষা করতে পাঠাতেন, আজ তিনি নিজেই নিয়মিত রিফাতকে স্কুলে পৌঁছে দেন।
তবে এই সাফল্যের মাঝেও চ্যালেঞ্জের অভাব নেই। পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব, শিক্ষাসামগ্রীর সংকট এবং স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা—এসবই প্রতিদিনের লড়াই। তবুও থেমে নেই ‘নগরফুল’।
স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা ও সচেতন নাগরিকদের অংশগ্রহণ পেলে এই উদ্যোগ আরও বিস্তৃত হতে পারে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। তাসনীম হোসেন বলেন, “আমরা চাই, দেশের প্রতিটি শহরে এমন অন্তত একটি হলিডে স্কুল থাকুক, যেখানে পথশিশুরা অন্তত সপ্তাহে কিছুটা সময় নিরাপদ ও ভালোবাসাময় পরিবেশে কাটাতে পারে।”
‘নগরফুল হলিডে স্কুল’ যেন প্রমাণ করে দিচ্ছে—শিক্ষা শুধু চার দেয়ালের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়, এটা ভালোবাসা, সহানুভূতি আর স্বপ্ন দেখানোর এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। আর এই প্রয়াসেই বদলে যেতে পারে হাজারো পথশিশুর ভবিষ্যৎ।
আমারবাঙলা/এফএইচ