দিনটা ছিল ২০১৩ সালের ৬ মার্চ। বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসা থেকে বেরিয়েছিল তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। লক্ষ্য ছিল সুধীজন পাঠাগার। এর পর নিখোঁজ হয় সে। ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনার এক যুগ পার হচ্ছে আজ। এতোদিনেও এই মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে পারেনি তদন্তকারী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
জীবিত অবস্থায় ত্বকী ছিল নিভৃতচারী। সেই সময় ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বিশ্বের সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিল। তার বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জের একজন শীর্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠক হলেও এই অঙ্গনের সবাই ছেলেকে চিনতো না। কিন্তু, মৃত ত্বকীকে সারাদেশের মানুষ চেনে। ত্বকীর হত্যার প্রতিবাদে এর আগে বিশ্বের ২৬টি দেশে প্রতিবাদ হয়েছে।
ওসমান পরিবার অভিযুক্ত
তার হত্যার পরপর প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। নজিরবিহীন সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৮ মার্চ নিহতের বাবা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন। সম্পূরক অভিযোগে তিনি শামীম ওসমান, ছেলে অয়ন, ভাতিজা আজমেরীসহ তার পরিবারের সন্ত্রাসীদের দায়ী করেন। প্রথমে পুলিশ মামলার তদন্ত করলেও এক পর্যায়ে স্থবিরতা দেখা দেয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব-১১। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তার বক্তব্যের ভিত্তিতে আল্লামা ইকবাল রোডে অভিযান চালিয়ে র্যাব হত্যাকাণ্ডের আলামত উদ্ধার করে।
২০১৪ সালের ৮ মার্চ তৎকালীন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলনে জানান, হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। তিনি ঘটনার জন্য আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রের খসড়া গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। শিগগিরই এটি আদালতে দাখিলের কথা জানান। কিন্তু খসড়া অভিযোগপত্রটি গতকাল বুধবার পর্যন্ত আদালতে দাখিল হয়নি।
শেখ হাসিনার বক্তব্যে বাধাগ্রস্ত বিচার
র্যাবের এই অভিযোগপত্র প্রস্তুতির খবরে বাগড়া দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৩ জুন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমানদের পাশে থাকার ঘোষণা দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে হেয় করতে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ পরিবারটি বারবার আঘাতের শিকার হয়েছে। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার শাসনামলে ও মুক্তিযুদ্ধের সময়, পঁচাত্তর-পরবর্তীতে এ পরিবারের ওপর আঘাত হয়েছে। যখন যে সরকার এসেছে, কখনও না কখনো এ পরিবারের ওপর হামলা-নির্যাতন করেছে।’ এ বক্তব্যের পর ত্বকী হত্যার বিচারকাজ সম্পূর্ণ থেমে যায়।
৫ আগস্টের পর মামলায় গতি
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর র্যাব আবার নড়েচড়ে বসে। আজমেরীর সহযোগী সাফায়েত হোসেন শিপন, মামুন মিয়া, আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে জামাই মামুন, কাজল হাওলাদার, আজমেরীর গাড়িচালক মোহাম্মদ জমশেদ ও পারভেজ গ্রেপ্তার হয়। এর মধ্যে মামুন মিয়া হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছে। বাকিরা জেলে। কাজল হাওলাদার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এর পর র্যাবের দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১১-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দীপক মজুমদার বলেন, ‘কাউকে গ্রেপ্তার করলে মানুষের চোখে পড়ে। মনে হয়, কাজ হচ্ছে। এর বাইরেও একটি অভিযোগপত্র তৈরির জন্য অনেক ধরনের কাজ আছে। মামলার তদন্ত এগোচ্ছে। শিগগির অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তিনি আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন।’
আসামিরা পালানোয় ক্ষুব্ধ নারায়ণগঞ্জবাসী
ত্বকী হত্যা মামলার আসামিরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ত্বকীর পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জবাসী। এ প্রসঙ্গে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ‘গত বছরের গত ৫ আগস্টের পরে আমরা শামীম, তার ছেলে অয়ন, ভাতিজা আজমেরীসহ পরিবারের খুনিরা যাতে পালাতে না পারে, সে দাবি করলাম। সে সময় র্যাব-১১-এর সিও লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বললেন, আজমেরী ওসমান নজরদারিতে আছে। কিন্তু, আমরা জেনেছি, আজমেরী প্রথমে নারায়ণগঞ্জের নিট কনসার্ন গার্মেন্টের মালিক জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে, পরে তার আত্মীয় জেলার ও একজন এএসপির বাড়িতে থেকে দেশের বাইরে চলে গেছেন।’
আজমেরীর দেশত্যাগে কারা সহযোগিতা করেছে, সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম কাজল। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি, জাহাজে করে শামীম, তার ছেলে অয়ন ও ভাতিজা আজমেরী দুই দফায় প্রথমে ভারত ও পরে অন্য দেশে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কীভাবে দেশের বাইরে গেল? কারা তাদের সহযোগিতা করলো? সরকার কেন এসব তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে না?’
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দীপক মজুমদার বলেন, ‘আজমেরী পালিয়ে গেছে আপনি কি নিশ্চিত? কোন তথ্যের ভিত্তিতে আপনি নিশ্চিত হলেন? আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।’
পরবর্তী ধার্য দিন ১৭ এপ্রিল
গত ২ মার্চ ত্বকী হত্যার ৮১তম নির্ধারিত তারিখ চলে গেছে। গত ১৭ এপ্রিল পরবর্তী ধার্য তারিখ। এ তথ্য জানিয়ে ত্বকী হত্যা মামলার আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু বলেন, ‘এই হত্যার বিচার শুরু না হলেও ত্বকী এখন সারাদেশের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।’
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ‘১২ বছর বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছি। এখন তাড়াহুড়া করে ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্র হোক, তা চাই না। প্রয়োজনে আরো দুয়েক মাস সময় যাক। কিন্তু, আমরা এমন অভিযোগপত্র চাই, যাতে আসামিদের হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টেও উপযুক্ত শাস্তির আদেশ বহাল থাকে।’
আজকের কর্মসূচি
ত্বকীর ১২তম হত্যাবার্ষিকীতে আজ সকাল ১০টায় নারায়ণগঞ্জের বন্দর খেয়াঘাটে জড়ো হবেন সংস্কৃতিকর্মীরা। পরে বন্দরের সিরাজ শাহ দরবার শরিফে ত্বকীর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। আগামী শনিবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় চাষাঢ়ায় নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচি আয়োজন করেছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট।
আমারবাঙলা/জিজি
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            