সংগৃহীত
নারী

‘শুঁটকি কিল্যা’য় কাজ করেন শুধুই নারীরা 

কক্সবাজার প্রতিনিধি

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলা। এ উপজেলা সাগরের সন্নিকটে হওয়ায় লবণ উৎপাদনের উতকৃষ্ট জায়গা। কিন্তু উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মৌলভিপাড়া সৈকত ব্যতিক্রম। এখানে চলছে শুঁটকি উৎপাদনের তোড়জোড়। সৈকতজুড়ে রয়েছে ২৫টির বেশি শুঁটকিমহাল; যা স্থানীয়ভাবে ‘শুঁটকি কিল্যা’ হিসেবে পরিচিত। মজার বিষয়, এসব শুঁটকিমহালে শ্রমিকদের সবাই নারী। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা শুঁটকি উৎপাদনে কাজ করেন।

সম্প্রতি সরেজমিন মৌলভিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, সাগরের তীরঘেঁষা গ্রামটির কয়েকটি মহালে শুঁটকি উৎপাদন করছেন ৫০ জনের বেশি নারী। ফরিদুল আলম নামের এক ব্যক্তির শুঁটকিমহালে গিয়ে দেখা যায়, শুঁটকি উৎপাদনের জন্য বাঁশের মাচা রয়েছে সাতটি। প্রতিটি মাচায় দু-তিনজন করে নারী শ্রমিক শুঁটকি উৎপাদন করছেন। মাচায় শুকাতে দেওয়া মাছের বেশির ভাগই চিংড়ি। কিছু মাচায় ছুরি, ফাইস্যা ও লইট্যা মাছ শুকাতে দেওয়া হয়েছে।

সকাল ছয়টা থেকে মহালটিতে কাজ করতে আসেন মৌলভিপাড়ার খুশী বেগম (২৫)। স্বামী গিয়াস উদ্দিন পেশায় জেলে। খুশী বেগম বলেন, সাগরে মাছ ধরা পড়ছে কম। এ কারণে আমার স্বামী কিছুদিন ধরে বেকার। তিনি সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শুঁটকিমহালে কাজ করে ২৫০ টাকা মজুরি পান। তবে তার উপার্জনের টাকায় সংসার চলে না। এলাকায় শুঁটকিমহালে কাজ করা ছাড়া নারীদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, এলাকার পুরুষেরা লবণমাঠে কাজ করেন, নারীরা শুঁটকিমহালে। শুঁটকি উৎপাদন বন্ধ হলে নারী শ্রমিকেরা বিপাকে পড়েন বলে জানান দুই সন্তানের জননী খুশী বেগম।

শুঁটকি উৎপাদনের কাজ করছিলেন আরেক নারী শ্রমিক রাবেয়া বেগম (৩৪)। তার স্বামী আবদুর রহিম পেশায় কৃষক। রাবেয়া বেগম বলেন, আমি শুঁটকিমহালে কাজ করছি ২০ দিন ধরে। আমার সংসারে দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সারাদিন কাজ করে ২৫০ টাকা পাই। তা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতেই কষ্ট হচ্ছে।

শুঁটকিমহালে নারীদের কম মজুরির বিষয়ে মহালের মালিক ফরিদুল আলম বলেন, পুরুষ শ্রমিকেরা মহালে কাজ করলে সাগরে নেমে ট্রলার থেকে মাছ কিনে ধুয়ে মহালে নিয়ে আসা, সন্ধ্যায় সেই মাছ গুদামে নেওয়াসহ বিভিন্ন বাড়তি কাজ করেন। তবে নারী শ্রমিকেরা কেবল মাচায় মাছ শুকাতে দেন। এর বাইরে কাজ তেমন করেন না। এ কারণে নারী শ্রমিকদের মজুরি অপেক্ষাকৃত কম।

ফরিদুল আলমের দক্ষিণ পাশে মো. জসিম নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দার আরেকটি শুঁটকিমহাল। সেখানেও ২০ জনের বেশি নারী শুঁটকি উৎপাদন করছেন। উত্তরপাশে আবদুস সালাম নামের আরেক ব্যক্তির মহালেও ১৬ নারীকে কাজ করতে দেখা যায়। মহালগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি লইট্যা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। এর বাইরে ছুরি ৭০০-৮০০ টাকা, ছোট চিংড়ি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও জেলা শহরেই এসব শুঁটকির দাম প্রায় দ্বিগুণ।

মহালের মালিকেরা জানান, কুতুবদিয়ায় শুঁটকি কেনার ব্যবসায়ী রয়েছেন ২৩ জন। তারা মহালের শুঁটকি কিনে ট্রলারে করে নিয়ে যান চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়তে। সেখান থেকে শুঁটকি সরবরাহ হয় তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

ফরিদুল আলমের মহাল থেকে অন্তত এক হাজার কেজি শুঁটকি কিনতে দেখা যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলামকে। তার বাড়ি উপজেলার আলী আকবরডেইল ইউনিয়নের তারলেরচর গ্রামে। ১২ বছর ধরে তিনি শুঁটকির ব্যবসা করছেন। কুতুবদিয়ার শুঁটকি ট্রলারে ভরে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে নিয়ে বিক্রি করেন। কুতুবদিয়ার বিষমুক্ত শুঁটকির স্বাদ ও কদর দুটোই বেশি জানিয়ে দিদারুল ইসলাম (৪৩) জানান, আগে প্রতি সপ্তাহে তিনি তিন হাজার কেজি শুঁটকি সরবরাহ করতেন। তবে এখন ৮০০ থেকে এক হাজার কেজি শুঁটকি খাতুনগঞ্জে সরবরাহ করেন। কারণ, সাগরে মাছ তেমন ধরা পড়ছে না।

মহালের কয়েকজন মালিক জানান, ট্রলার থেকে তারা প্রতি মণ কাঁচা চিংড়ি এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায় কিনে শুঁটকি করেন। প্রতি মণে কাঁচা মাছ থেকে পান ১০ কেজি শুঁটকি। প্রতি কেজি ২৫০ টাকায় বিক্রি করলে ১০ কেজিতে লাভ থাকে এক হাজার টাকার মতো। শ্রমিকসহ মহালের আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিলে ৫০০ টাকার বেশি থাকে না। সাগরে বেশি মাছ ধরা পড়লে তখন বেশি লাভ করা যায়। প্রতি সপ্তাহে এ এলাকার মহাল থেকে অন্তত তিন মেট্রিকটন শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে বলেও জানান মালিকেরা।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মৌলভিপাড়াসহ পাঁচটি গ্রামের পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি সমুদ্রে বিলীন হয়। ভেঙে যায় পাঁচ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ। সেই থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সড়কের দুই পাশে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করে আসছে। শুঁটকি উৎপাদনে নিয়োজিত নারীরা এসব জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারেরই সদস্য।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুতুবদিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বছরের ছয় মাস এই সৈকতে শুঁটকি উৎপাদন চলে। মহালের শ্রমিকদের সবাই নারী, সবাই জলবায়ু উদ্বাস্তু।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

রাস্তা অবরোধ করার অধিকার কারো নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ফরিদপুরের সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তা অবরোধের ঘট...

সুশীলা কারকির উত্থান যেভাবে

নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের প্...

১২ দিনের ছুটিতে যাচ্ছে সরকারি নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো

শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১২ দিনের ছুটিতে যাচ্ছে সরকারি নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্য...

আয়ের দিক দিয়ে ফের মেসিকে ছাড়িয়ে শীর্ষে রোনালদো

রেকর্ডের দৌড়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। কিন্...

সাবালেঙ্কার সাফল্যের রহস্য

সদ্য ইউএস ওপেন নারী এককের শিরোপাজয়ী বেলারুশের টেনিসকন্যা আরিনা সাবালেঙ্কা নিজ...

ডিজিটাল অর্থনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণে বাড়ছে প্রবৃদ্ধির গতি

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অবিশ্বাস্য রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে...

রাস্তা অবরোধ করার অধিকার কারো নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ফরিদপুরের সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তা অবরোধের ঘট...

শহীদ রফিক হত্যা: নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাকিব গ্রেপ্তার

মানিকগঞ্জের শিবালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ রফিক হত্যা মামলার অন্যত...

কক্সবাজারে স্ত্রীকে ধর্ষণের পর তার সামনে স্বামীকে হত্যা, ঘাতক আটক

কক্সবাজার শহরের উত্তরণ আবাসিক এলাকায় এক চাকমা যুবককে জবাই করে হত্যার পর তার স...

সোনা চোরাচালানে জড়াচ্ছেন বিমানের ক্রুরা, ‘লঘু শাস্তিতে’ রেহাই

আকাশপথে সোনা চোরাচালান চক্রে জড়াচ্ছেন রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা