জাতীয়

সরকারি চাকুরেরা আপাতত পাচ্ছেন না মহার্ঘ ভাতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপাতত পাচ্ছেন না মহার্ঘ ভাতা। জানুয়ারি থেকেই এ ভাতা কার্যকরের যে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, অর্থনীতির বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতিতে সেখান থেকে সরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মহার্ঘ ভাতা বাস্তবায়ন হলে রাশ টানা যেত না মূল্যস্ফীতির, সমাজে দেখা দিত বৈষম্য– এমন শঙ্কায় সব মহল থেকে সরকারের এ উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ পটভূমিতে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে মহার্ঘ ভাতা থেকে কিছুটা পিছিয়েছে সরকার। তবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য ঠিক রেখে মহার্ঘ ভাতার অর্থ সংস্থান করা সরকারের জন্য বেশ কঠিন। তবু অন্য খাত থেকে টাকা কাটছাঁট করে ভাতা দেওয়ার খসড়া চূড়ান্ত করেছিল অর্থ বিভাগ। তবে বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বিষয়টিতে সায় না দিয়ে মহার্ঘ ভাতার নথি ফেরত পাঠিয়েছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতত এ ভাতা দেওয়া সমীচীন হবে না। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিষয়টি ফের বিবেচনা করা যেতে পারে।

সূত্র জানায়, সাড়ে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীকে মূল বেতনের সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার খসড়া প্রস্তুত করেছিল অর্থ বিভাগ। তবে ইতোমধ্যে পাওয়া সরকারি চাকরিজীবীর বাড়তি ৫ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) বাদ দেওয়ার সুপারিশও করা হয়। অর্থ বিভাগের হিসাবে এটি বাস্তবায়নে এক অর্থবছরে বাড়তি খরচ হবে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের খসড়া প্রস্তাবে ব্যয় কিছুটা কমাতে ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও প্রথম থেকে দশম গ্রেডের কর্মচারীদের ১০ বা ১৫ শতাংশ হারে ভাতার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথম থেকে দশম গ্রেডে ১০ শতাংশ দেওয়া হলে পাঁচ হাজার কোটির কিছু বেশি টাকার প্রয়োজন ছিল। আর ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ব্যয় আরেকটু বেড়ে দাঁড়াত– প্রায় ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ এ পরিমাণ টাকার সংস্থান করে সংশোধিত বাজেটে তা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করে।

তবে সরকার এ উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই নানা মহলে সমালোচনা শুরু হয়। বিশ্লেষকরা বলছিলেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে গত জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণ ব্যাপক কমেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।

তাই সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই জনগণের পকেট থেকে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব তুলতে অর্থবছরের মাঝপথে শত পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। পরে অবশ্য জনরোষের শঙ্কা ও সমালোচনার মুখে কয়েকটি পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর পুনর্বিবেচনা করা হয়। মহার্ঘ ভাতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তীব্র সমালোচনা হয়। অনেকেই বলতে থাকেন, সরকারি চাকুরের মহার্ঘ ভাতার টাকা জোগাতেই শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। এমন আলোচনা-সমালোচনার মুখে মহার্ঘ ভাতা থেকে আপাতত পিছু হটল সরকার।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনশীল মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করার কথা বলা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এখনই মহার্ঘ ভাতা দেওয়াটা যৌক্তিক সময় নয়।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। তা ছাড়া অন্য কোনো খাতের বেতন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতি রেখে বাড়েনি। এ পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেবে। একই সঙ্গে সমাজে বৈমষ্য সৃষ্টি করবে। অন্যদের প্রতি ন্যায্যতা হবে না। সার্বিকভাবে এ সময়ে সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত না নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এমন তো নয় যে সরকারি কর্মচারীরা খুব কম বেতনে চাকরি করছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে সরকারি চাকরিজীবীর বেতন বেসরকারি খাতের চেয়ে বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। উপসচিব হলেই বিনা সুদে গাড়ির ঋণ এবং সেই গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে বাড়তি ৫০ হাজার করে টাকাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। তার পরও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া থেকে সরে আসাটাই যৌক্তিক।

এই অর্থবছরের বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বৈষম্যের শিকার হওয়া প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েক দফায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া প্রশাসনের পদবঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৫ কোটি টাকাও দেওয়া হয়। এর সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা যুক্ত হলে চলতি বাজেটে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় বেশ খানিকটা বেড়ে যেত।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র আরো বলছে, মহার্ঘ ভাতার বাড়তি অর্থায়নের হিসাব করা হয়েছে চলতি বাজেটের বরাদ্দের ভিত্তিতে। তবে প্রতিবছর বাজেটে বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ ৬ থেকে ৮ শতাংশ বাড়ে। সে হিসাবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দাঁড়াতে পারে প্রায় সাড়ে ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা বাবদ যোগ হতো আরও প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হতো প্রায় সাড়ে ৯৬ হাজার কোটি টাকা।

সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর একটি নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করার কথা। সর্বশেষ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে অষ্টম বেতন কাঠামো কার্যকর হয়। সে সময় নতুন কাঠামোর সুপারিশ না করলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার প্রস্তাব ছিল বেতন কমিশনের। তবে ২০২৩ সালের জুলাইয়ের আগপর্যন্ত প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে আসছিলেন। পরে বাড়তি মূল্যস্ফীতির কথা বলে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণাসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আসছিলেন সরকারি চাকরিজীবীরা।

এ পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। পরে তা কার্যকর না হলেও বিশেষ সুবিধা হিসেবে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি মূল বেতনের আরও ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়। ফলে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন।

এদিকে, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি দিতে আবারো মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এরই অংশ হিসেবে গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর আওতাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা সংস্থানের বিষয় পর্যালোচনার জন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।

আমারবাঙলা/জিজি

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

এমিতে ‘অ্যাডোলেন্স’-এর জয়জয়াকার

বাংলাদেশ সময় সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে ঘোষণা করা হলো ৭৭তম এমি অ্যাওয়ার্ডস।...

রাকসু নির্বাচনে কার কী প্যানেল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-রাকসু নির্বাচনের এ পর্যন্ত নয়টি প্...

হাত না মেলানো : ভারতের ব্যাখ্যা, পাকিস্তানের প্রতিবাদ

আগা সালমান-শাহিন আফ্রিদিরা হয়তো সেটা ভেবেই মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন...

লন্ডনে বাংলাদেশি মাকে ‘বর্ণবাদী’ মন্তব্য, ছেলের ওপর হামলা

লন্ডনে হামলার শিকার হয়েছেন এক বাংলাদেশি তরুণ। তরুণের ভাষ্য, তাঁর হিজাব পরা মা...

বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে তিস্তার পানি

টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি আব...

গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল: জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন

গাজার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের একটি স্...

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনা

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা আরও সুশৃঙ্খল করতে সরকারি হাসপাতালগুলোকে নতুন নির্দেশনা...

ক্রীড়া পরিদপ্তরে দুদকের অভিযান

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ক্রীড়া পরিদপ্তরের বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প...

এক লাফে ট্যারিফ বাড়ল গড়ে ৪০ শতাংশ

বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তি উপেক্ষা করেই নতুন ট্যারিফের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়...

বগুড়ায় মা ও ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা

বগুড়ার শিবগঞ্জে এক নারী ও তার কলেজপড়ুয়া ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা