একদিকে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত, অন্যদিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। এর ভেতরেই মাঠের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াতসহ সমমনা ৮ দল।
কিন্তু, এসব কি নির্বাচনের প্রস্তুতি, নাকি রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করার ইঙ্গিত?
জুলাই অভ্যুত্থানের পর ন্যূনতম যে স্থিরতা এসেছিল দেশের রাজনীতিতে, তা যেন আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর যে জুলাই সনদ সই হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন নিয়ে এখন দেখা দিয়েছে নতুন মতবিরোধ। এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি।
বিশ্লেষকদের অভিমত, এটা বিএনপির কৌশল, যা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং একইসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অন্যান্য দলকেও নির্বাচনমুখী হতে বাধ্য করেছে।
বিপরীতে, বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার মধ্যেই পাঁচ দফা দাবি আদায়ে আগে থেকেই রাজপথে থাকা জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা ৮ দলের সক্রিয়তা এখন বেশ দৃশ্যমান।
জামায়াতসহ আট দলের দাবি, দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে হবে এবং জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করতে হবে।
৬ নভেম্বর ঢাকায় পল্টনে সমাবেশ থেকে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ১০ নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করা না হলে ১১ নভেম্বরের পর ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে।
পরদিন খুলনায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার একই সুরে বলেন, নির্বাচনের আগে গণভোট না হলে দেশ রাজনৈতিক সংকটে পড়বে।
এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান একেবারেই ভিন্ন। গত ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসের অনুষ্ঠানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই গণভোট দাবিকে বলেছেন 'নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র'।
এমন পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩ নভেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিন সময় দিয়েছে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য।
এরইমধ্যে জামায়াত দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপিকে একাধিকবার সংলাপের আহ্বান জানালেও বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি। গতকাল রোববার পর্যন্ত সেই সমঝোতার কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি।
এর আগ থেকেই ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকায় নতুন জটিলতা তৈরি হয়ে আছে। বিএনপির অভিযোগ, কমিশন তাদের ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট প্রতিবেদন থেকে বাদ দিয়েছে।
জামায়াত বলছে, বিএনপি ইচ্ছে করেই বিভাজন সৃষ্টি করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই অনৈক্যের মধ্যে তাই সমাধানের পথ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বিএনপির মিত্র-জোট গণতন্ত্র মঞ্চের গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জেএসডি ও ভাসানী জনশক্তি পার্টি—এই ছয় দল এবং এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদসহ নয় দলের নেতারা গত ৫ নভেম্বর বৈঠক করেন। কিন্তু গণভোটের ধরন আর শর্ত নিয়ে তারাও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
এদিকে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে অন্য দলগুলোর তৎপরতাও বাড়ছে। জামায়াত প্রায় বছরখানেক আগেই জুলাই অভ্যুত্থানের পরপর প্রাথমিক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে রেখেছে। এনসিপিও বলছে শিগগিরই ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করবে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যেও এখন জোট-রাজনীতির নানান সমীকরণ চলছে। জামায়াত চাচ্ছে সব ইসলামপন্থি দলকে এক মঞ্চে আনতে। কিন্তু, কওমি মাদরাসা-ভিত্তিক প্রভাবশালী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বের মধ্যেই জামায়াতবিরোধী মত স্পষ্ট। তবু নির্বাচনী সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগির আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
বিএনপির পুরোনো মিত্র জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এখনো দলটির সঙ্গেই আছে বলে মনে হচ্ছে। বাম ও প্রগতিশীল ঘরানার ছয় দলকেও বিএনপির ঘনিষ্ঠ অবস্থানে দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি এখনো যেন অস্থিরতার ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াত—দুই পক্ষই এনসিপিকে সঙ্গে নিয়ে জোট করতে আগ্রহী। কিন্তু এনসিপির অনেক নেতা চান স্বতন্ত্রভাবে লড়তে, নিজেদের 'মধ্যপন্থি' দল হিসেবে পরিচিত করতে।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দলগুলো একমত না হলে সরকারের সিদ্ধান্ত কী হতে পারে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নন।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, এই অচলাবস্থার দায় সরকারেরই।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক যেমন বলেছেন—যে সমঝোতা আট মাসে হয়নি, তা আট দিনেরও কম সময়ে হওয়া প্রায় অসম্ভব।
তার মতে, গণভোটের আগে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনই এখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ।
সব মিলিয়ে, রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট—সবকিছুর মধ্যেই রয়ে গেছে অনিশ্চয়তা। তাই প্রশ্নটা ঘুরে-ফিরে সামনে আসছে—রাজনীতির মাঠ কি আবারও উত্তপ্ত হতে যাচ্ছে?
আমারবাঙলা/এফএইচ