বড় টুর্নামেন্টের মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য তো এখানেই! আন্ডারডগ যেখানে স্তব্ধ করে দেয় পরাশক্তিকে। ছোট্ট একটি ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায় পাহাড়ের ভিতও।
ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোলে ক্লাব বিশ্বকাপেও শুক্রবার (২০ জুন) তেমনটাই হলো। বাংলাদেশ সময় সকালে এ ম্যাচ শুরুর আগে কেউ যদি বোতাফোগোর কাছে পিএসজি হারের কথা বলতেন, তবে তা দিবাস্বপ্নই মনে হতো। পিএসজি ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট চ্যাম্পিয়নস লিগসহ ‘ট্রেবল’জয়ী দল। দলে তারকার ছড়াছড়ি। এর চেয়েও বড় বিষয়, পিএসজির সাম্প্রতিক ছন্দ।
লুইস এনরিকের অধীনে নান্দনিক ফুটবল পসরা সাজিয়েছে বসেছে ফরাসি ক্লাবটি। যদিও সেটা শুধু ফুটবল রোমান্টিকদের কাছে। প্রতিপক্ষের কাছে প্যারিসের ক্লাবটির খেলাকে নির্মমই মনে হবে। কতটা নির্মম, সেটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের প্রতিপক্ষ ইন্টার মিলানকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।
সেদিন মিলানকে ৫-০ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জিতেছিল পিএসজি। এমন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বোতাফোগো যতই দক্ষিণ আমেরিকান শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক কোপা লিবের্তাদোরেস চ্যাম্পিয়ন হোক, তবু তাদের একটু পিছিয়েই রেখেছিলেন অনেকে। কিন্তু ফুটবলের সুন্দর সব গল্প তো ট্রেন্ড ভাঙার মধ্য দিয়েই লেখা হয়। লেখা হয় পরাশক্তির পতনের মধ্য দিয়েও।
শুক্রবার সকালেও লেখা হলো তেমন এক গল্প। বোতাফোগোর অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গেছে ইউরোপসেরা পিএসজি। ৩৬ মিনিটে স্ট্রাইকার ইগর জেসুসের করা একমাত্র গোলটিই গড়ে দিয়েছে ম্যাচের পার্থক্য। সতীর্থ জেফারসন সাভারিনোর দারুণ এক পাস ধরে গোলটি করেন জেসুস যা বোতাফোগোর ১-০ গোলের জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রথম দল হিসেবে তাদের শেষ ষোলোতেও পৌঁছে দিয়েছে। এর আগে নিজেদের প্রথম ম্যাচে সিয়াটল সাউন্ডার্সকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল তারা। ফলে ২ ম্যাচ ৬ পয়েন্ট নিয়ে পৌঁছে গেছে নকআউট পর্বে।
ম্যাচে অবশ্য গোল করা আর লক্ষ্যে শট নেওয়া ছাড়া ইতিবাচকভাবে আর কোনো দিক থেকেই পিএসজির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেনি ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটি। ৭৫ শতাংশ বলের দখল রেখে ১৬ শট নিয়ে মাত্র ২টি লক্ষ্যে রাখে পিএসজি। অন্য দিকে ২৫ শতাংশ বলের দখল রেখে বোতাফোগো ৪টি শট নিলেও প্রতিটিই ছিল লক্ষ্যে।
আর এই নিশানাভেদের শক্তিতেই পিএসজিকে পেছনে ফেলে ম্যাচ নিজেদের করে নিয়েছে রিও দি জেনিরোর ক্লাবটি। তবে লক্ষ্যভেদের সঙ্গে নিজেদের শক্তি অনুযায়ী কৌশলী ফুটবল, দৃঢ় রক্ষণ ও প্রতি-আক্রমণে ভীতি ছড়ানোর দক্ষতায়ও বাজিমাত করে বোতাফোগো। বিশেষ করে বোতাফোগোর দুর্দান্ত রক্ষণের কারণে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি পিএসজি ফরোয়ার্ডরা।
অথচ এই ম্যাচের আগে অপ্টার সুপারকম্পিউটারের হিসাবে পিএসজির জয়ের সম্ভাবনা ছিল ৮১.৯ শতাংশ। সর্বশেষ তিন ম্যাচে জয়ের পথে পিএসজির গোল ব্যবধান ছিল ১২-০। কিন্তু এমন অপ্রতিরোধ্য ফলও শেষ পর্যন্ত বোতাফোগোর বিপক্ষে ম্যাচে ঘুরে দাঁড়াতে উজ্জ্বীবিত করতে পারেনি এনরিকের দলকে।
৫৩ হাজার ৬৯৯ জন দর্শকের সামনে পাওয়া এই জয়ে নতুন ইতিহাসও লিখেছে বোতাফোগো। এর মধ্য দিয়ে ফিফার কোনো টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো বর্তমান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নকে হারানোর কীর্তি দেখাল কনমেবলের (দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ) কোনো দল। পাশাপাশি এই জয়ে পিএসজির বিপক্ষে অপরাজিত থাকার রেকর্ডও ধরে রাখল বোতাফোগো। ৪১ বছর আগে ১৯৮৪ সালে ৬ আগস্ট মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। সেই প্রীতি ম্যাচে কালো-সাদারা জিতেছিল ৩-১ গোলে।
বোতাফোগোর জয়ে ক্লাব বিশ্বকাপের এবারের আসরে কনমেবল দলগুলোর না হারার কীর্তিও অক্ষুণ্ন থাকল। ক্লাব বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৮টি ম্যাচ খেলেছে দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাবগুলো। যার ৫টিতে জিতেছে তারা এবং ড্র করেছে ৩ ম্যাচ।
বোতাফোগোর ইতিহাস গড়ার নায়ক জেসুস দুর্দান্ত এক সময় পার করছেন। পিএসজির বিপক্ষে করা গোলটিসহ টানা চার আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করেছেন তিনি। শুধু গোল করে নয়, উদ্যাপনেও নজর করেছেন ২৪ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার।
ম্যাচ শেষে অনুভূতি জানাতে গিয়ে জেসুস বলেছেন, ‘যখন আমি দেয়াল (নিরাপত্তাবেষ্টনী) বেয়ে উঠলাম, সত্যি বলতে তখন অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলাম-সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল। আমি শুধু তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা আমার কাজের ওপর বিশ্বাস রেখেছে। আগেও বলেছি, যখন বোতাফোগোতে আসি, অনেকেই আমার সামর্থ্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু আমি জানতাম, আমি এই দলকে কী দিতে পারি। আমি এখানে যা কিছু গড়েছি, তাতে আমি খুবই আনন্দিত।’
আমারবাঙলা/জিজি