দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখালেও ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি চোখে পড়ার মতোভাবে কমেছে। একই সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও তার সুফল মূলত ধনী শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফলে বৈষম্য বেড়েছে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে—এমনই চিত্র তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে চরম দারিদ্র্য ১২.২ শতাংশ থেকে কমে ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে এবং মাঝারি দারিদ্র্য ৩৭.১ শতাংশ থেকে ১৮.৭ শতাংশে নেমেছে। এ সময়ে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে এবং ৯০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। জীবনমানের উন্নতি, বিদ্যুৎ–শিক্ষা–পয়োনিষ্কাশনের মতো প্রয়োজনীয় সেবার প্রাপ্তি বেড়েছে।
তবে উদ্বেগের বিষয়—দেশের প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ এখনো অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো অঘটনে আবার দারিদ্র্যে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠেছে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্য কমলেও শহরাঞ্চলে সেই গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ২০২২ সালের মধ্যে প্রতি চারজন বাংলাদেশির একজন শহরে বসবাস শুরু করলেও শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে, নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করতে পারেনি।
এর ফলে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে এবং তরুণদের বড় একটি অংশ কম মজুরির কাজে বাধ্য হয়েছে—১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ–তরুণীর প্রায় অর্ধেকই কম আয়ে কাজ করছেন। প্রতি পাঁচজন নারীর একজন বেকার, আর শিক্ষিত নারীদের বেকারত্ব আরও বেশি।
অভিবাসন অনেক পরিবারের দারিদ্র্য কমানোর উপায় হিসেবে কাজ করছে। প্রবাস আয়ের সুফল তুলনামূলকভাবে গরিব পরিবার বেশি পাচ্ছে। তবে বিদেশ যাওয়ার উচ্চ ব্যয় দরিদ্রদের সুযোগ সীমিত করে রেখেছে। দেশের ভেতর অভিবাসী শ্রমিকেরা আবার শহরের অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি এলাকায় বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়লেও উপকারভোগী বাছাইয়ে ব্যাপক ত্রুটি রয়েছে। ২০২২ সালে এই সুবিধা পাওয়া লোকজনের ৩৫ শতাংশই ধনী পরিবার; অথচ অতি দরিদ্রদের অর্ধেকও এসব সুবিধা পায়নি। একইভাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সার খাতে সরকারি ভর্তুকির বড় অংশও ধনী পরিবারগুলোর হাতে চলে যায়।
দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে রিপোর্টে চারটি মূল করণীয় তুলে ধরা হয়েছে—
১) উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থানের ভিত্তি শক্ত করা,
২) দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা,
৩) প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করা,
৪) শক্তিশালী রাজস্বনীতি ও লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানো।
বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সার্জিও অলিভিয়েরি বলেন, আঞ্চলিক বৈষম্য কমলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শহর–গ্রাম বৈষম্য বাড়াচ্ছে। তাঁর মতে, উদ্ভাবনী নীতি গ্রহণ, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, শহরে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিতে দরিদ্রবান্ধব মূল্য–শৃঙ্খল গড়ে তোলা এবং কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসের হার পুনরুদ্ধার ও ত্বরান্বিত করতে পারবে।
● আমারবাঙলা/এফএইচ