মোহাম্মদ মনির হোসেন
জাতীয়

ভাইরাল নাকি ভাইরাস: সস্তা খ্যাতির ইঁদুরদৌড় ও সামাজিক অবক্ষয়ের দলিল

মোহাম্মদ মনির হোসেন

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এক অদ্ভুত সমাজের বাসিন্দা। এই সমাজে খ্যাতি বা ‘পরিচিতি’ যেন এক উন্মত্ত নেশা, যা পাওয়ার জন্য মানুষ নিজের মান, হুঁশ, এমনকি ন্যূনতম শালীনতাও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। ডিজিটাল মিডিয়ার প্রসারে ‘ভাইরাল’ হওয়া এখন সাফল্যের নতুন মাপকাঠি। কিন্তু এই তথাকথিত ‘ভাইরাল’ হওয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকা অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নির্লজ্জতা আর ব্যক্তিগত জীবনের লাগামহীন প্রদর্শন—এসব কি স্রেফ পরিচিতি? নাকি ধীরে ধীরে সমাজকে গ্রাস করে নেওয়া এক মারণব্যাধি, এক 'ভাইরাস'? বর্তমান যুগে ভাইরাল হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কীভাবে মানুষকে নৈতিকতার গণ্ডি পেরিয়ে এক গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এই বিশ্লেষণে তা-ই তুলে ধরা হবে।

খ্যাতির নতুন সংজ্ঞা- 'ভাইরাল' হওয়াটাই শেষ কথা

একসময় খ্যাতি অর্জন করতে প্রয়োজন হতো দীর্ঘদিনের সাধনা, মেধা ও প্রতিভার। শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী—সকলেই পরিচিতি লাভ করতেন নিজেদের সৃষ্টিশীল বা গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে। কিন্তু এখন চিত্রটা পাল্টে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত টিকটক, ইউটিউব, ফেসবুক রিলস-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো সস্তা জনপ্রিয়তার এক সহজ রাস্তা খুলে দিয়েছে। রাতারাতি ‘স্টার’ হয়ে ওঠার হাতছানি পেয়ে বহু মানুষ মানসম্মত কনটেন্ট তৈরির বদলে বেছে নিচ্ছেন চটকদার, বিতর্কিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অশ্লীল পথ। একটি সাধারণ বা হাস্যকর ভিডিও মুহূর্তেই লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে, আর সেই ভিউ ও লাইকের সংখ্যাই যেন এখন ব্যক্তির আত্মমর্যাদা পরিমাপের নিক্তি। এই পরিচিতি ক্ষণস্থায়ী হতে পারে, কিন্তু সেই নেশা যেন মরফিন থেকেও তীব্র।

সস্তা বিনোদনের অন্ধকার দিক

ভিডিও কনটেন্ট তৈরি বর্তমানে একটি পেশায় পরিণত হয়েছে। অর্থ উপার্জন, ব্র্যান্ডিং এবং স্রেফ ‘ফলোয়ার’ বাড়ানোর এই প্রতিযোগিতায় কনটেন্ট নির্মাতাদের একটি বড় অংশ নিজেদের সৃজনশীলতা বাদ দিয়ে বেছে নিয়েছেন 'লজ্জা ত্যাগ' বা 'মান-বিসর্জন'-এর কৌশল। সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ, পারিবারিক ঐতিহ্য বা শালীনতা তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বোঝা মাত্র। ক্যামেরার সামনে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি, অশালীন পোশাক বা বিতর্কিত ও অসংলগ্ন বক্তব্যকে তারা পরিণত করেছেন পুঁজি হিসেবে। একজনের মানসম্মানের হানি অন্য অনেকের কাছে সস্তা বিনোদনের খোরাক। একটি ভিডিও কতটা ভাইরাল হবে, তা যেন নির্ভর করে তার ‘শক ভ্যালু’-এর ওপর। যত বেশি অরুচিকর, উদ্ভট বা বিতর্কিত, তত বেশি মনোযোগ। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে ক্যামেরার সামনে সর্বজনীন পণ্যে পরিণত করছেন, যেখানে ভিউয়ারের রুচির স্তরে নেমে আসতে দ্বিধা করছেন না। এটি একদিকে যেমন তাদের নিজেদের ব্যক্তিত্বের অবনমন ঘটাচ্ছে, তেমনি সমাজে এক ধরনের অসুস্থ রুচিকেও প্রতিষ্ঠিত করছে।

গণ-উন্মাদনা ও অবক্ষয়ের প্ল্যাটফর্ম

টিকটক-এর মতো শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলো 'ভাইরাল হওয়ার ভাইরাস'-এর অন্যতম প্রধান বাহক। এখানে কিছু মানুষ নিজেদের শারীরিক ভাষা, পোশাক এবং আচরণের চরম নির্লজ্জ প্রদর্শনী করতে দ্বিধা করছেন না। রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি জনসমাগমের স্থানেও অদ্ভূত বা যৌন-উত্তেজক নাচের ভঙ্গি, অশালীন সংলাপ এবং বেসামাল কার্যকলাপের মাধ্যমে ভিডিও তৈরি করে ‘ট্রেন্ড’ তৈরি করার চেষ্টা চলছে।

অ্যাপগুলোর আসক্তি যুবসমাজকে ঠেলে দিচ্ছে বাস্তব জীবন থেকে দূরে। তারকাখ্যাতি পাওয়ার নিরর্থক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে অনেকে জীবনের ঝুঁকিও নিচ্ছেন, যা প্রায়শই মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এই প্ল্যাটফর্মে অশ্লীলতা, যৌনতা ও সহিংসতা প্রাধান্য পাওয়ায় এটি পরিণত হয়েছে এক সামাজিক ব্যাধিতে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এক ধরনের আসক্তি, যা মাদকাসক্তির মতোই ক্ষতিকর। সমাজের একটা বিশাল অংশের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী এই নেশায় বুঁদ হয়ে তাদের শিক্ষাজীবন, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করছে।

কাপল ভিডিও’র নামে ব্যক্তিগত জীবনের নগ্ন প্রদর্শন

সাম্প্রতিক সময়ে 'কাপল ভ্লগ' বা দম্পতিদের ভিডিও কনটেন্ট একটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত জীবনের নগ্ন প্রদর্শনে পরিণত হচ্ছে। সম্পর্কের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো, বেডরুমের খুনসুটি, এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত আলোচনাগুলোও এখন ক্যামেরার লেন্সে বন্দি হয়ে লক্ষ লক্ষ দর্শকের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে। বিবাহের মতো পবিত্র বন্ধনকে ব্যবহার করা হচ্ছে স্রেফ ভিউ আর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। ফুলশয্যার রাতের মতো একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ব্লগিং বা দাম্পত্য কলহকে জনসমক্ষে আনা—এইগুলো স্রেফ কনটেন্ট নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবনের পবিত্রতার প্রতি এক চরম উদাসীনতা ও অসম্মানের পরিচায়ক। দর্শকরা মজা পেলেও এই ধরনের ভিডিও সম্পর্কের স্বাভাবিক গতিপথ, মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধারণাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এটি প্রমাণ করে যে, খ্যাতির মোহে ব্যক্তিরা সম্পর্কের স্বাভাবিকতা ও মর্যাদা বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। এই লাগামহীন প্রদর্শন সমাজে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভুল বার্তা দিচ্ছে এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ‘প্রাইভেসি’-এর মতো মৌলিক ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

ভাইরাল নাকি ভাইরাস

ভাইরাল হওয়ার এই উন্মাদনা একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। একদিকে এটি মানুষকে পরিচিতি এবং আয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু যখন এই পরিচিতি অর্জন করতে গিয়ে মানুষ স্বেচ্ছায় তাদের নৈতিক মানদণ্ড বিসর্জন দেয়, নির্লজ্জতাকে প্রশ্রয় দেয় এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সর্বজনীন তামাশায় পরিণত করে, তখন তা আর ‘ভাইরাল’ থাকে না; তা হয়ে ওঠে এক ‘ভাইরাস’। এটি এমন এক ভাইরাস, যা দ্রুত ছড়ায় এবং সমাজের সুস্থ চিন্তাধারাকে পচিয়ে দেয়। এই ভাইরাসের লক্ষণগুলো হলো—মান-অপমানবোধহীনতা, সস্তা খ্যাতির প্রতি আসক্তি, নৈতিকতার প্রতি উদাসীনতা এবং বাস্তব জীবনের চেয়ে ভার্চুয়াল লাইক-কমেন্টকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এর ফলে, সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা, কমে যাচ্ছে মানসম্মত কনটেন্টের কদর, এবং তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে—ভাবছে যে নির্লজ্জতাই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি।


'ভাইরাল নাকি ভাইরাস'—এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহভাবে ভাইরাসের দিকেই ইঙ্গিত করছে। খ্যাতি বা পরিচিতি অবশ্যই কাম্য, কিন্তু তা যেন আসে গঠনমূলক কাজ, মেধা ও শালীনতার মাধ্যমে। যদি জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য মানসম্মানকে বিসর্জন দিতে হয়, তবে সেই খ্যাতি সমাজকে কোনো ইতিবাচক বার্তা দিতে পারে না। বরং, তা কেবল সমাজের অভ্যন্তরে একটি ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করে। এই 'ভাইরাস' থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে কনটেন্ট নির্মাতাদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি দর্শকদেরও রুচির মান উন্নত করতে হবে। সস্তা, অশ্লীল ও নির্লজ্জ কনটেন্টকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলেই সুস্থ ও শালীন ডিজিটাল সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। নয়তো এই ‘ভাইরাল’ নেশা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে দিবে।

——প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, মেহের ডিগ্রি কলেজ, শাহরাস্তি, চাঁদপুর

আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়াল সরকার

দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য...

জাপানে নতুন জোট সরকার, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তাকাইচি

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এবং ছোট ডানঘেঁষা দল জাপ...

অবশেষে জুলাই জাতীয় সনদে সই করল গণফোরাম

জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছে গণফোরাম। রবিবার (১৯ অক্টোবর) জাতীয় সংসদের এলড...

আইন অনুযায়ী শাপলা প্রতীক দেওয়া সম্ভব নয়: ইসি আনোয়ারুল

সাংবিধানিক আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রতীকের তালিকায় শাপলা না থাকায় তা বরাদ্দ দেওয়া...

তিন দিনের নন শিডিউল ফ্লাইটের খরচ মওকুফ

শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনায় আগামী তিন দিন নন-শিডিউল (আগু...

জোবায়েদ হত্যায় ছেলে মাহিরকে থানায় দিলেন মা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী মো. জোবায়েদ হোসেন হত্যা মামলায় অভিযু...

ভাইরাল নাকি ভাইরাস: সস্তা খ্যাতির ইঁদুরদৌড় ও সামাজিক অবক্ষয়ের দলিল

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এক অদ্ভুত সমাজের বাসিন্দা। এই সমাজে খ্যাতি বা &...

ইবিতে সংগঠনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে করলেন ছাত্রদল সহ-সভাপতি জহির

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখার সাংগঠনিক কার্যক্রমের অগ্রগতি ও নতুন নেতৃত্ব...

নোয়াখালীতে জামায়াত-বিএনপির সংঘর্ষ,আহত-৪০

নোয়াখালীর সদর উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্...

চট্টগ্রামে নতুন জেলা প্রশাসক হলেন সাইফুল ইসলাম

চট্টগ্রামের নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা