দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠায় একমত হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশে নেওয়া ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের অধিকাংশ। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব মেনে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ২৩টি দল চায়, যে দল সংসদ নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, উচ্চকক্ষে তত আসন পাবে। ভোটের সংখ্যানুপাতের ঘোর বিরোধী বিএনপিসহ ছয়টি দল চায়, নিম্নকক্ষে যে দল যত শতাংশ আসন পাবে, উচ্চকক্ষে তত আসন পাবে।
প্রধানমন্ত্রী পদ দু’বারে সীমাবদ্ধ করার সুপারিশেও একমত হয়নি বিএনপিসহ সাতটি দল।
বিএনপি চায়, কেউ টানা দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তবে বিরতি দিয়ে পরবর্তী সময়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন দল চায়, কেউ জীবনে দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়েও ঐকমত্য হয়নি। বিএনপি চায়, সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের (এমপি) ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্যরা চায় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিধিনিরাও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটার হবেন ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ পদ্ধতিতে। তবে বিএনপিসহ প্রায় সব দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে গোপন ব্যালটে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর এসব মতামত এসেছে। বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয়ে ছয় ঘণ্টা চলে চতুর্থ দিনের সংলাপ। দু’দিনের সাপ্তাহিক ছুটির পর আগামী রবিবার হবে পঞ্চম দিনের সংলাপ।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে গতকাল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। শুরুতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আলোচনার সময়, দলগুলোর দাবিতে মধ্যাহ্নবিরতির পর উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে আলোচনা হয়। রোববার বাকি তিন বিষয়ে সংলাপ হবে বলে জানিয়েছে কমিশন।
সংখ্যানুপাতের বিরুদ্ধে অনড় বিএনপি
বিএনপি কোনো বিষয়ে অনড় থাকবে না বলে দাবি করলেও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তারা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন মানবেন না। এ অবস্থানের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, প্রস্তাব করা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো দলের পক্ষে এককভাবে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়ার নজির নেই। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি হলে, উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেতে হবে, যা অসম্ভব। ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে উচ্চকক্ষে সরকারি দল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পাবে না। তখন কোনো আইন করতে পারবে না সরকার।
জাপান, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে সংসদের নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হয়। ওই সব দেশে কার্যকর এ নজিরের বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
নিম্নকক্ষে যে দল যত শতাংশ আসন পাবে, উচ্চকক্ষে তত আসন পেলে দ্বিক্ষের সংসদের প্রয়োজন কী– এ প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেছেন, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, শিল্পীসহ প্রতিভাবানদের মেধা কাজে লাগাতে তাদের উচ্চকক্ষে আনতে চায় বিএনপি।
ভারতের উচ্চকক্ষে দেশটির রাষ্ট্রপতি শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, শিল্পীসহ প্রতিভাবানদের মধ্য থেকে ১২ জনকে সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারেন। কিন্তু তারা ভোট দিতে পারেন না। বিএনপির প্রস্তাবিত পদ্ধতি অনুযায়ী, উচ্চকক্ষের সদস্যরা আইন প্রণয়ন, সংবিধান সংশোধনেও ভোট দিতে পারবেন। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় নয়, এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা রয়েছে। তাই অন্যদের সঙ্গে মেলালে হবে না। বিএনপির অবস্থানকে সমর্থন করেছে এলডিপি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলেছেন, বিএনপি নারী আসন বাড়িয়ে ১০০ নির্ধারণের সুপারিশে একমত হয়েছে। নিম্নকক্ষের ৪০০ এবং উচ্চকক্ষের ১০০ এমপির প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। গোপন ভোটের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইলেক্টোরাল পদ্ধতিটির বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন মত দিয়েছে। এর মধ্যে বেশি মত এসেছে উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষের সদস্যদের গোপন ব্যালটের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার বিষয়ে। এ ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি। তবে সব রাজনৈতিক দল গোপন ভোটের পক্ষে একমত হলে এতে একমত হবে বিএনপি।
সংখ্যানুপাতে ছাড় দেবে না জামায়াত-এনসিপি
প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, লেবার পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফ্রন্টসহ অধিকাংশ দল।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, সংসদের উভয় কক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন চান তারা।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, তারা ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষে নির্বাচনের পক্ষে। ভোটের আগে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসানত আবদুল্লাহ বলেছেন, উচ্চকক্ষের আসন ভোটের অনুপাতে বণ্টন হতেই হবে। এটিই মৌলিক সংস্কার। প্রধানমন্ত্রীর পদ দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে হবে গোপন ব্যালটে।
অন্য দলগুলোর নেতারা বলছেন, ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনে প্রায় সব দলই নীতিগতভাবে একমত। সিপিবি ও বাসদ জানিয়েছে, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে রোববারে বৈঠকে সিদ্ধান্ত জানাবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, বড় দলগুলো মৌলিক সংস্কারে একমত না হওয়ায় তিনি ব্যথিত। সরকারের এত টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু সরকারের কাজ এগোচ্ছে না। যে বড় দল গত ১৫ বছর নির্যাতিত হয়েছে বলে দাবি করে, তারাই নিপীড়নের পথ বন্ধে রাজি হচ্ছে না। তারা পরিবর্তন না চাইলে এগোনো সম্ভব না। গণঅধিকার সভাপতি নুরুল হক বলেন, সংখ্যানুপাতিক উচ্চকক্ষ হতে হবে। একই কথা বলেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
গত বৃহস্পতিবারের আলোচনায় সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে একজন সর্বোচ্চ দু’বার প্রধানমন্ত্রী থাকার কথা বলা হয়েছে। প্রথম ধাপের আলোচনার পরে দু’বার বিরতির পর আরও একবার প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টিতে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সমর্থন দেয়।
এই আলোচনার শুরুতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রস্তাব হচ্ছে কোনো ব্যক্তি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এখানে বার ও মেয়াদের প্রশ্ন এসেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে দুই বার।
বিএনপির সালাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় ঐকমত্য কমিশন বলেছিল, কোনো ব্যক্তি পরপর দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একবার বিরতি দিয়ে আবার হতে পারে কী না। বিএনপি বলেছিল, এ নিয়ে দলে আলোচনা করবে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তাঁরা সংসদের মেয়াদ ব্যবহার করার পক্ষে।
কমিশন ৬৪ জেলা পরিষদ এবং ১২ সিটি করপোরেশনকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইলেক্ট্রোরাল কলেজ গঠনের সুপারিশ করেছে। এতে একমত হয়েছে জামায়াত, এনসিপিসহ ২০ দল। বিএনপিসহ ছয়টি দল বিপক্ষে। ইসলামী আন্দোলনসহ একাধিক দল সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে।
জামায়াতে নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন গোপন ব্যালটে আয়োজনে আপত্তি নেই। তবে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের নয়, স্থানীয় সরকারের অন্য প্রতিনিধিদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটার করা যেতে পারে। এনসিপির জাবেদ রাসিন বলেন, উচ্চকক্ষ ছড়া ইলেকটোরাল কলেজ সম্ভব না।
ফ্যাসিবাদের দোসর কেন প্রশ্ন
বাংলাদেশ জাসদ ও জাকের পার্টিসহ যেসব দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল, সংলাপে তাদের আমন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গণঅধিকার পরিষদ ও লেবার পার্টি। নুরুল হক নূর বলেন, সংলাপে ফাসিবাদের দোসর দলকে আমন্ত্রণ জুলাইয়ের চেতনার অবমাননা।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, সরকার এবং ঐকমত্য কমিশন আওয়ামী লিগের দোসরদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমারবাঙলা/জিজি