বেনাপোল প্রতিনিধি: চার বছর পার হয়ে গেছে দেশজুড়ে আলোচিত বেনাপোল কাস্টমসের লকার থেকে থেকে ১৯ কেজি স্বর্ণ চুরির ঘটনা। বেনাপোল কাস্টমস হাউজ থেকে সোনা লুটের ঘটনার সাথে ঢাকা বিমানবন্দরে চুরি হওয়া সোনা লুটের ঘটনা এবং স্টাইল একই সুত্রে গাঁথা। ভিন্ন শুধু স্থান কাল এবং স্বর্ণের পরিমান।
ঢাকার মত বেনাপোলেও সেদিন সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। চুরির দিন জানা গেল এক মাস ধরে বন্ধ ছিল সিসি ক্যামেরা। ভোল্ট তালাবদ্ধ অথচ ভেতরে সোনা আছে সোনা নেই। অথচ উদ্ধার হয়নি ওই স্বর্ণ। হদিসও মেলেনি লকারের সেই দুটি চাবি।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা কেবল সাক্ষ্য গ্রহণেই থমকে আছে। এখানেও মামলার ৩৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১০ জন। সাক্ষীরা নির্ধারিত সময়ে আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় মামলাটির বিচারকাজ থমকে আছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
কাস্টমস হাউজের পুরানো দোতলা ভবনের যে কক্ষটিতে লোহার ভোল্ট বা সিন্দুক রাখা ছিল সেটি অনেক বেশি সুরক্ষিত। বাইরের যে কেউ এখান থেকে চুরি করে পালিয়ে যেতে পারবে না। স্বর্ণ চুরি হয়ে যাওয়ার স্থান থেকে সার্বক্ষনিক নজরদারির প্রধান গেটটি মাত্র ৫০ গজ দুরুত্বে। স্বর্ণ চুরি হবার বিষয়টি প্রথম থেকেই রহস্যজনক।
হাউজের বাইরে থেকে চোর এসে চুরি করলে বাকি ৭৫ টি স্বর্ণেরবার এবং নগদ ৩ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা কেন ফেলে যাবে এ প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের। গত ৪ বছরে অধরা রয়ে গেছে ১৯ কেজি স্বর্ন লুটের অজানা রহস্য।
এদিকে, সিসি ক্যামেরা আর প্রশাসনিক নিরাপত্তার মধ্যে লকার খুলে চুরি হওয়া স্বর্ণ চার বছরেও উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সচেতনমহল। তারা বলছেন, কাস্টসমের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পূর্ব পরিকল্পনায় এই চুরি সংগঠিত হয়। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী প্রথম থেকে আন্তরিক হলে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে চুরি হওয়া স্বর্ণবার উদ্ধার কঠিন হওয়ার কথা না।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম থেকে এই স্বর্ণ চুরির ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কাস্টমসের পাথে সুর মিলিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কতিপয় নেতা কর্মীর উপর দোষ চাপায়। তাদের তদন্তকারী কর্মকর্তার সামনে হাজির হয়ে জবানবন্দীও দিতে হয়। অথচ এ ঘটনায় তাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এমন ঘটনায় পরিকল্পনাকারীরা পার পেয়ে যাওয়ায় বেনাপোল কাস্টমসের পর ঢাকা বিমান বন্দরে আরও একটি স্বর্ণ চুরির ঘটনা অন্য অপরাধীদের সাহস যুগিয়েছে।
তবে মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি বলছে, ‘লকারের দায়িত্বে থাকা কাস্টমস কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও বহিরাগতদের দিয়ে লকার দেখ ভাল করায় এই চুরি সংগঠিত হয়েছে। আসামিরা চুরি করা স্বর্ণ বিক্রি করে ফেলায় সোনা উদ্ধার সম্ভব হয়নি। তবে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ৫ কাস্টমস কর্মকর্তাসহ ৭ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত আসামিরা জামিনে রয়েছেন।
বেনাপোল কাস্টম ও সিআইডির চার্জশিটের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর টানা ৩ দিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সরকারি ছুটি এবং ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে কাস্টমস বন্ধের সুযোগে কাস্টমস হাউজের পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলার গোডাউনের তালা ভেঙে চোরেরা ভেতরে যায়। পরে তারা ভল্টের তালা ভেঙে ১৯ কেজি ৩১৮ দশমিক তিন গ্রাম স্বর্ণ চুরি করে। ঐ সময়ে যার মূল্য প্রায় ১০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
এই ভল্টের চাবি ছিল তৎকালীন ভল্ট ইনচার্জ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুলের কাছে। গোডাউনের অন্যান্য লকারে স্বর্ণ, ডলারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র থাকলেও সেগুলো চুরি হয়নি। ভল্ট ভাঙার সময় কাস্টমস হাউসের সবগুলো সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।
১২ নভেম্বর সকালে বিষয়টি জানাজানি হলে কাস্টমস হাউজের রাজস্ব কর্মকর্তা এমদাদুল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে চুরির মামলা করেন বেনাপোল পোর্ট থানায়। ভল্ট ইনচার্জ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুলকে তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর মামলাটি অগ্রগতির জন্য তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি।
দেড় বছরেরও বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ১৪ জুন ৫ কাস্টমস কর্মকর্তাসহ ৭ জনকে আটক দেখিয়ে চার্জশিট দেন সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম। এতে বলা হয়, লুট করা স্বর্ণবার আসামিরা বিক্রি করে ফেলায় উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
বর্তমানে আসামিরা সবাই উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। চার্জশিটে অভিযুক্তরা হচ্ছেন- খুলনা বটিয়াঘাটার জয়পুর গ্রামের রণজিৎ কুন্ডুর ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ বিশ্বনাথ কুন্ডু, রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দীর বাঁধুলি খালপাড়া গ্রামের মৃত জালাল সরদারের ছেলে কাস্টমস হাউজের সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুল সরদার, বরিশাল আগৈলঝাড়ার চেঙ্গুটিয়া গ্রামের মৃত আব্দুর রবের ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম মৃধা, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের অম্বিকাপুর গ্রামের মৃত
আজিজুল হকের ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ আর্শাদ হোসাইন, খুলনার তেরখাদার বারাসাত গ্রামের মৃত আতিয়ার রহমান মল্লিকের ছেলে বেনাপোল কাস্টমসের এনজিও কর্মী আজিবার রহমান মল্লিক, বেনাপোলের ভবেরবের পশ্চিমপাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল শেখের ছেলে শাকিল শেখ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার চারুয়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভল্ট ইনচার্জ মোহাম্মদ অলিউল্লাহ।
আলোচিত এ মামলাটি বর্তমানে যশোর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ কত তারিখে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ দিন ধার্য ছিল ও ওই মামলাটি শেষ করতে আর কত দিন লাগবে তাও জানেন না রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। এই মামলার কাস্টমস কর্মকর্তা, আনসার সদস্য ও পুলিশ সদস্যসহ ৩৪ জন সাক্ষী। এরমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১০ জন।
যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এম ইদ্রিস আলী জানান, আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণেই এই মামলার কার্যক্রমেই সীমাবন্ধ রয়েছে। দ্রুতই বাকীদের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে দিয়ে মামলাটি শেষ করা হবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যশোর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ৭ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে স্বর্ণ চুরির সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তবে স্বর্ণ উদ্ধার ও লকারের আরও দুইটি চাবি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বেনাপোলের সাধারণ ব্যবসায়ী আনিছুর রহমান জানান, এতগুলো স্বর্ণ খেয়ে ফেলার জিনিস না। স্বর্ণ বা স্বর্ণ বিক্রির টাকা এতদিনে কোনটাই উদ্ধার হলো না ? আসামিরা আটক হলেও সবাই জামিনে। আমাদের দেশের প্রশাসন এখন অনেক দক্ষ। আরো আন্তরিক হলে চুরি স্বর্ণ বা স্বর্ণ বিক্রি হলে তার টাকা উদ্ধার কঠিন কিছু না।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেকপোস্ট আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ বিপুল জানান, কাস্টমস লকার থেকে স্বর্ণ চুরির ঘটনা ৪ বছর পার হতে গেল। অথচ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে স্বর্ণ উদ্ধার না হওয়ায় আমরা হতাশ। বেনাপোল কাস্টমস হাউস থেকে স্বর্ণ চুরি করে চক্রটি অনেকটা পার পেয়ে যাওয়ায় এবার ঢাকা বিমান বন্দরে স্বর্ণ চুরিতে অপরাধীদের সাহস জুগিয়েছে। যদি বেনাপোল কাস্টমস থেকে লুট হওয়া স্বর্ণ উদ্ধার হতো তবে হয়তো আবারও নতুন করে সরকারের এ সম্পদ লুটের কথা শুনতে হতো না।
লকারের সেই দুই চাবির হদিস মেলেনি : বেনাপোল কাস্টম হাউজের যে লকার থেকে স্বর্ণবারগুলো চুরি হয়েছে সেই লকারের তিনটি চাবি। চুরি হওয়ার সময়ে একটি চাবি পাওয়া গেলেও বাকী দুটি চাবি পাওয়া যায়নি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা সংস্থার তদন্তেও সেই দুটি চাবি তারা হদিস পাননি। স্বর্ণ চুরি মামলার প্রধান আসামি রাজস্ব কর্মকর্তা শাহিবুল ইসলামসহ সব আসামি জামিনে রয়েছেন।
এই কর্মকর্তা জানান, তিনি তার পূর্ববতী কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের কাছ থেকে ফাইল কেবিনে থাকা সব স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা বুঝে পেয়েছিলেন। তবে তাকে ফাইল কেবিনের একটি মাত্র চাবি দেওয়া হয়েছিল। বাকি চাবিগুলো পূর্বের কর্মকর্তা দেয়নি। এ চুরির সাথে আমি জড়িত না। যদি আরো ভালভাবে তদন্ত করা হয় তবে প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়বে ও স্বর্ণ উদ্ধার হবে। দোষী না হয়েও আমি চাকুরিচ্যুত।
এবি/ওশিন
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            