অনেকে প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করেন, কিন্তু যখন তাঁদের প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি কোরআন জার্নালিং করেন?’ তখন বেশিরভাগ মানুষ বিষয়টি বুঝেই উঠতে পারেন না। অনেকেই প্রথমবার শুনলে অবাক হন—‘এটা আবার কী?’
কোরআন জার্নালিং মানে হলো একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি বা নোটবুক রাখা, যেখানে কোরআনের আয়াত থেকে পাওয়া শিক্ষা, অনুভব এবং জীবনে তার ব্যবহারযোগ্য দিকগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়। এটি একান্তই আত্মিক একটি অভ্যাস, যা কোরআনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আরও গভীর করে তোলে।
যাঁরা নিয়মিত কোরআন বুঝে পড়তে চান, কিন্তু মাদ্রাসা বা ইসলামিক ক্লাসে সময় দিতে পারেন না, তাঁদের জন্য এটি হতে পারে একটি কার্যকর পদ্ধতি। একটা ছোট কোরআন নোটবুক রাখুন—এই ছোট প্রয়াসই আপনার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে।
কীভাবে জার্নালিং করবেন?
কোরআন পড়ার সময় শুধু তিলাওয়াতে থেমে না থেকে অর্থ অনুধাবনে মন দিন। অর্থ পড়তে পড়তে যেসব শব্দ বা আয়াতে আপনি থেমে যান, চোখে জল আসে বা মন স্পর্শ করে—সেগুলো লিখে রাখুন। সেই সঙ্গে জীবনের যে কোনো স্মৃতি বা বাস্তবতা যা ওই আয়াতের সঙ্গে মিলে যায়, তাও লিখে নিন। যদি কোনো আয়াতে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পড়ে শান্তি অনুভব করেন, সেটিও নোট করুন।
এই লেখাগুলো আত্মিক চিকিৎসার মতো কাজ করে। কোরআন থেকে পাওয়া দিকনির্দেশনা অন্য কোনো উৎস থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
শুরুর উপযুক্ত সময় ও সুরা
জীবনে যদি কোনো কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাহলে কোরআন জার্নালিং শুরু করার এটাই হতে পারে সেরা সময়। আপনি চাইলে নিজেকে আত্মিকভাবে উন্নত করার সংকল্প নিয়ে এই চর্চা শুরু করতে পারেন, যাতে আল্লাহর ওয়াদার ওপর মনোযোগী থাকা যায়। তাঁর কালাম আপনাকে সান্ত্বনা দেবে এবং একসময় আপনি অন্ধকারের মধ্যেও আলো খুঁজে পাবেন।
শুরুর জন্য সুরা দুহা একটি আদর্শ সুরা। এতে রয়েছে আশা, আশ্বাস ও আল্লাহর রহমতের বাণী। সুরাটি সেই সময় নাজিল হয়েছিল, যখন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) কিছু সময় ওহি না পেয়ে উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তখন আল্লাহ বলেন:
“তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও নন।”
(সুরা দুহা, আয়াত: ৩)
“আখিরাত তোমার জন্য এই দুনিয়ার চেয়ে অনেক ভালো।”
(আয়াত: ৪)
“তিনি কি তোমাকে অভাবী পাননি এবং তারপর তোমার অভাব পূরণ করেননি?”
(আয়াত: ৮)
কোরআন জার্নালিংয়ের সুফল
কঠিন সময়ে আমরা অনেক প্রশ্ন করি—‘আমার সঙ্গে এমন কেন হচ্ছে’, ‘আল্লাহ কি আমায় ভুলে গেছেন’, ‘আমি কি পারব এগিয়ে যেতে?’ এই জার্নালিং আপনাকে মনে করিয়ে দেবে—আল্লাহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে আছেন, এবং আশা ও আস্থার আলো এখনো নিভে যায়নি। এটি আত্মবিশ্বাস, মানসিক প্রশান্তি এবং ঈমানের দৃঢ়তা এনে দেয়।
উপকারিতাগুলো সংক্ষেপে:
১. আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত হয়:
তাফসির পড়ে আয়াত বুঝে তা লিখলে আপনি কোরআনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারবেন।
২. কষ্টের সময় মনে শান্তি আসে:
আয়াতের প্রতিফলনে জীবনের সমস্যাগুলোর জন্য আপনি কোরআন থেকে উত্তর খুঁজে পাবেন।
৩. চিন্তায় গভীরতা বাড়ে, ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার অভ্যাস তৈরি হয়।
জার্নালিংয়ের সহজ নিয়ম
জার্নালিং করার কোনো বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই। তবে সহজ কয়েকটি ধাপ মেনে আপনি শুরু করতে পারেন:
-
সৃষ্টিশীল শিরোনাম দিন: প্রতিটি জার্নাল সেশনের শুরুতে সুরা বা আয়াতের নাম সুন্দর করে লিখুন।
-
পাঠ ও প্রেক্ষাপট বোঝা: আয়াতটি কবে, কোথায়, কী পরিস্থিতিতে নাজিল হয়েছিল, তা জানার চেষ্টা করুন।
-
হৃদয় ছোঁয়া আয়াত বাছুন: এমন আয়াত লিখুন, যা আপনার মনে রেখাপাত করে। অর্থ নিয়ে ভাবুন।
-
নিজের উপলব্ধি লিখুন: আয়াত থেকে আপনি কী শিখলেন বা কীভাবে তা আপনার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত—তা লিখে রাখুন।
-
দোয়ার মাধ্যমে শেষ করুন: আল্লাহর কাছে হেদায়েত ও সাহায্য প্রার্থনা করুন।
জার্নালিং থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি
১. ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব:
“আল্লাহ কীভাবে উপমা দেন, তা কি দেখ না? একটি পবিত্র কথা এমন একটি ভালো গাছের মতো, যার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উঁচু, যা তার রবের ইচ্ছায় সব সময় ফল দেয়।”
(সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ২৪)
২. কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর পরিকল্পনা:
“আল্লাহ কোনো ব্যক্তির ওপর তার সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপান না।”
(সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)
৩. ভরসার বিনিময়ে অপ্রত্যাশিত সাহায্য:
“যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে, আল্লাহ তার জন্য পথ বের করবেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেবেন, যা সে কল্পনাও করেনি।”
(সুরা তালাক, আয়াত: ২–৩)
“আমি আমার বিষয় আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ তার বান্দাদের সম্পর্কে সব জানেন।”
(সুরা গাফির, আয়াত: ৪৪)
৪. নির্বাচনের স্বাধীনতা:
“মানুষ কি মনে করে, তারা বলবে ‘আমরা বিশ্বাস করেছি’ এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না?”
(সুরা আনকাবুত, আয়াত: ২)
৫. কষ্ট মানেই ব্যর্থতা নয়:
“তিনি মহিমান্বিত, যিনি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখেন; যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, কে সবচেয়ে ভালো কাজ করে।”
(সুরা মুলক, আয়াত: ১–২)
কোরআন জার্নালিং এমন একটি অভ্যাস, যা আমাদের হৃদয় আল্লাহর বাণীর সঙ্গে যুক্ত করে। এটি আমাদের জীবনে ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও আশার বীজ বপন করে। আপনার জীবন যদি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যায়, কিংবা আপনি নিজেকে আল্লাহর আরও কাছে নিয়ে যেতে চান—তাহলে আজ থেকেই শুরু করুন এই সফর।
আমারবাঙলা /এফএইচ