সংগৃহীত
সারাদেশ

দক্ষিণাঞ্চলে বিলুপ্তির পথে দেশীয় ৫ প্রজাতির মাছ

বরিশাল ব্যুরো

দেশীয় প্রজাতির মাছ উদ্বেগজনক হারে হারিয়ে যাচ্ছে। মাছগুলোর বিষয়ে কোনো গবেষণা, তথ্য এমনকি পর্যবেক্ষণও নেই মৎস্য অধিদফতরের। তবে দফতটি জানিয়েছে, বরিশাল বিভাগ থেকে বিলুপ্তির পথে পাঁচটি মাছ রয়েছে। মাছগুলো হচ্ছে, রয়না, সরপুটি, বাইম, তারা বাইম ও পাবদা।

ঝালকাঠি সদর উপজেলার শতদশকাঠি গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ সুলতান মাতুব্বর। তিনি বলেন, ‘মোগো ছোডকালে গাঙে খেও (জাল ফেলা) দিলেই ভ্যাদা (ভেদা) মাছ পাইতাম। ভ্যাদা মাছের মজা অইন্যরহম। এহন গাঙে নাই, কোলায় (ফসলের মাঠ) নাই, নদী-নালায় নাই ভ্যাদা।’

তিনি বলেন, দেশি মাছ এহন আর আগের মতন নাই। উটকাল, চ্যাং (টাকি), মাগুর, কৈ, হরপুডি (সরপুটি), হিং (শিং), ট্যাংরা, মলা, ঢেলা, চ্যালা, হউল (শোল), বোয়াল, আইড়, বাইম, খইলসা, ফলি, চিংড়ি, গজার, বাশপাতারি, বেলে, দারকিনা, তিত পুঁটি, চিতল, পোমা (পোয়া), বক থুরিনা (কাইক্কা), দগরি মাছ (চেউয়া) আরো কতরহোমের মাছ খাইছি জীবনে। হ্যা এহন আর নাই। এহনগো মানসে ব্য়লার খাইয়াই শান্তি।

প্রতিবেশী নরেশ শীল বলেন, ভাইগো— গত হইয়া যাওয়া কতেক মাছ এহন বাজারে ওডে। কিন্তু স্বাদ নাই হেরহমের। কারণও আছে, হাডে-বাজারে যে কই, হিং, কোরাল পাওন যায় হেগুলা চাষের। ব্য়লাল মুরহার খাওন খাওয়াইয়া ডাঙ্গোর (বড়) হরে। স্বাদও বিস্বাদ।

বরিশাল অঞ্চলে ভেদা নামে পরিচিত সুস্বাদু মাছটির প্রমিত নাম রয়না মাছ। এর আরেকটি জনপ্রিয় নাম হলো মেনি মাছ বা নন্দই। খোদ মৎস্য অধিদপ্তর বলছে রয়নাসহ বেশ কয়েকটি মাছ বিলুপ্তির পথে। অথচ নদী ও জলাশয় প্রধান বরিশাল বিভাগে দেড় দশক আগেও ভেদা মাছের প্রাচুর্য ছিল ইর্ষণীয়।

বরিশালের পোর্ট রোড পাইকারী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, নথুল্লাবাদ কাচাবাজার, বাংলাবাজার, নতুনবাজার, রূপাতলী বাজার, তালতলী মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নদী, সাগর ও চাষের মাছে বাজার সয়লাব। দেশীয় প্রজাতির মাছ নেই বললেই চলে। এ ছাড়া বাবুগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ, মুলাদী ও উজিরপুর উপজেলার কয়েকটি বাজারের মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানিয়েছেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ বাজারে খুব কম উঠছে। এর প্রধান কারণ খাল, বিল, ডোবায় মাছ নেই।

পোর্ট রোডের ব্যবসায়ী রুবেল বলেন, মাঝে মধ্যে কিছু পরিমাণের ভেদা মাছ বাজারে আসে। তাও পরিমাণে মাত্র এক দুই কেজি। গত বছর এক কেজি ভেদা মাছ এনেছিলেন চেংগুটিয়ার একজন। ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছেন।

তালতলী বাজারের ব্যবসায়ী ফারুক মীর বলেন, সরপুটি, দেশি পাবদা, মাগুর, কৈ, শিং, মলা, ঢেলা, চ্যালা, বাইম, খইলসা, চিতল, কাইক্কা, চেউয়া মাছ এখন বাজারে আসে না বললেই চলে। আমরা শুধু ইলিশ, চাষের কোরাল, চাষের কই, শিং, মাগুর, পাঙাশ আর কার্প জাতীয় মাছ বিক্রি করি। এগুলো চাষ হয় তাই এগুলোই নির্দিষ্টভাবে বাজারে আসে। দেশীয় মাছ হারিয়ে গেছে বললেই হয়।

নতুনবাজারে ষাটোর্ধ্ব মকবুল হোসেন বলেন, দেশীয় মাছ আমাদের ঐতিহ্য। এই মাছ শুধু যে খেতে সুস্বাদু তা নয় বরং উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া যায় বিধায় বিপুল পরিমাণের অর্থ সাশ্রয় করে। আমার ছোট বেলায় দেখেছি প্রত্যেকের ঘরে মাছ ধরার জাল ছিল। যখন দেখতো রান্না করার কিছু নেই ঘরের পাশের নদী, খাল বা ডোবায় জাল ফেলে মাছ ধরতো। আমিও অনেক ধরেছি। উজিরপুরের ভরাকোটায় আমার বাড়ি। ওখানে এখনো নদী, খাল, জলাশয় জীবন্ত। কিন্তু দেশীয় মাছ নেই। আমরা এখন পাঙাশের জাতি। বাজারে গিয়ে দেখবেন বড় বড় পাঙাশ সাজায়ে রেখেছে।

গবেষণা বলছে, দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ২৫ শতাংশ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছ। নদী কমিশনের তথ্য মতে, দেশে মোট নদী এক হাজার আটটি। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রবহমান নদী আছে ৯৩১টি। নাব্য হারানো নদীর সংখ্যা ৩০৮টি। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৫টি, রংপুর বিভাগে ৭১টি, রাজশাহী বিভাগে ১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি, সিলেট বিভাগে ১০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি এবং খুলনা বিভাগে ৮৭টি নদী নাব্য হারিয়েছে। নাব্য হারানো নদীর তালিকায় বরিশাল বিভাগের নাম নেই। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার সবগুলো নদী এখন পর্যন্ত সচল থাকলেও এসব নদী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে মাছের প্রাচুর্য। খাল, জলাশয়, বিলে দেখা মিলছে না মাছের।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করায় দিনে দিনে দেশীয় প্রজাতির মাছ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। দুই দশক আগেও আমরা দেখেছি দক্ষিণাঞ্চলের নদী, নালায় দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। কিন্তু দুই দশকে এত বেশি কীটনাশক ব্যবহৃত হয়েছে ফসলের ক্ষেতে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছের জীববৈচিত্র্যে।

তিনি বলেন, দেশে প্রয়োজনের অনুকূলে প্রতি বছর যে পরিমাণে কীটনাশক আমদানী করা হয় অবৈধপথে তার কয়েকগুণ বেশি কীটনাশক আসছে। সেই কীটনাশকগুলো আমাদের জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষক না বুঝে তার ফসলের জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করলেও ক্ষতিটা হয়ে যাচ্ছে অন্যস্থানে। তা ছাড়া শিল্প কারখানার দূষণ, নদী দূষণ, পানি দূষণ, অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা শিকার, নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহারের কারণে নদী ও জলাশয় প্রধান অঞ্চল হলেও বরিশাল বিভাগ থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ আমরা হারাতে বসেছি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট পটুয়াখালী উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপকেন্দ্র প্রধান ড. মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, আমরা বর্তমানে খাচায় বোয়াল মাছ চাষ ও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ নিয়ে কাজ করছি। দেশীয় প্রজাতির মাছ কেন হারিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে আসলে আমাদের কোনো জানাশোনা নেই। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকেন্দ্র ফ্রেশ ওয়াটার ফিস নিয়ে কাজ করছে না।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। পর্যায়ক্রমে এই মাছগুলো কমে যাচ্ছে। এর কারণ বিল, নদী, খাল, পুকুর, জলাশয় কমে যাচ্ছে। এতে দেশীয় প্রজাতির কৈ, শিং, মাগুর, রয়না, সরপুটি, পাবদা, শৌল, টাকি অর্থাৎ অতীতে যে মাছগুলো প্রিয় ছিল সেগুলো দুস্প্রাপ্য হয়ে গেছে। এরমধ্যে বিলুপ্তির পথে রয়না, সরপুটি, বাইম, তারা বাইম আর পাবদা মাছ।

তিনি বলেন, এসব মাছের প্রজননস্থানগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিশেষত পানি সেচে একেবারে শুকিয়ে মাছ শিকার ও চাষাবাদ করা, অবাধে কীটনাশক ব্যবহারে রেণু পোনা ধ্বংস হচ্ছে বিধায় বরিশাল অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে।

নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, মৎস্য অধিদফতর থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ ও শামুক উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলায় চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশীয় মাছ সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে। তবে কী পরিমাণে মাছ কমেছে, কী কী প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে তার তথ্য বা পর্যালোচনা নেই বলে স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

রাস্তা অবরোধ করার অধিকার কারো নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ফরিদপুরের সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তা অবরোধের ঘট...

সুশীলা কারকির উত্থান যেভাবে

নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের প্...

আয়ের দিক দিয়ে ফের মেসিকে ছাড়িয়ে শীর্ষে রোনালদো

রেকর্ডের দৌড়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। কিন্...

১২ দিনের ছুটিতে যাচ্ছে সরকারি নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো

শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১২ দিনের ছুটিতে যাচ্ছে সরকারি নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্য...

সাবালেঙ্কার সাফল্যের রহস্য

সদ্য ইউএস ওপেন নারী এককের শিরোপাজয়ী বেলারুশের টেনিসকন্যা আরিনা সাবালেঙ্কা নিজ...

ডিজিটাল অর্থনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণে বাড়ছে প্রবৃদ্ধির গতি

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অবিশ্বাস্য রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে...

রাস্তা অবরোধ করার অধিকার কারো নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ফরিদপুরের সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তা অবরোধের ঘট...

শহীদ রফিক হত্যা: নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাকিব গ্রেপ্তার

মানিকগঞ্জের শিবালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ রফিক হত্যা মামলার অন্যত...

কক্সবাজারে স্ত্রীকে ধর্ষণের পর তার সামনে স্বামীকে হত্যা, ঘাতক আটক

কক্সবাজার শহরের উত্তরণ আবাসিক এলাকায় এক চাকমা যুবককে জবাই করে হত্যার পর তার স...

সোনা চোরাচালানে জড়াচ্ছেন বিমানের ক্রুরা, ‘লঘু শাস্তিতে’ রেহাই

আকাশপথে সোনা চোরাচালান চক্রে জড়াচ্ছেন রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা