চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজন করে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) আইসিসির কাছ থেকে ৬০ লাখ মার্কিন ডলার পাবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৭৩ কোটির কাছাকাছি।
অর্থের এ হিসাব বড় কিছু নয়। পাকিস্তানের অন্যকিছুতে খড়া কাটল।
ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি যতগুলো টুর্নামেন্ট আয়োজন করে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ওয়ানডে সংস্করণের বিশ্বকাপ। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল পাকিস্তান। এরপর গত ২৯ বছরে আর কোনো ওয়ানডে বিশ্বকাপ তো বটেই, আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টই আয়োজন করতে পারেনি দেশটি।
এই তিন দশকে ছেলেদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ হয়েছে সাত বার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নয় বার, নয় বার চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও। একই সময়ে মেয়েদের ক্রিকেটে ওয়ানডে বিশ্বকাপ হয়েছে সাত বার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নয় বার। আর জাতীয় দলের বাইরে সবচেয়ে বড় যে আসর, ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, সেটিও গত তিন দশকের মধ্যে হয়েছে ১৪ বার।
সব মিলিয়ে ২৯ বছরের মধ্যে পাঁচটি প্রতিযোগিতায় হয়েছে ৫৬টি আসর। ক্রিকেটের পুরোনো দেশগুলোর একটি হয়েও এতগুলো আইসিসি টুর্নামেন্টের একটিও আয়োজন করতে পারেনি পাকিস্তান। কারণ, যেকোনো টুর্নামেন্ট আয়োজনের যে পূর্বশর্ত— অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—সেটিতেই আশ্বস্ত করতে পারেনি পাকিস্তান।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের হামলা এবং এরপর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের সরাসরি প্রভাব ছিল পাকিস্তানে। ওই সেপ্টেম্বরেই পাকিস্তান সফরের কথা ছিল নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের, সেটি তারা পিছিয়ে দেয় পরের বছরের এপ্রিল পর্যন্ত। বিলম্বিত সেই সফরে কিউইরা করাচিতে পৌঁছানোর পর আসে আরেক ধাক্কা।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটারদের অবস্থানরত হোটেলের কাছেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে সফরটি তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল হয়ে যায়। একই বছরের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া দল তাদের পাকিস্তান সফরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। সেবার পাকিস্তান দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদের হোম সিরিজটি খেলে শ্রীলঙ্কা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
মাঝখানে ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব বিদেশি দলের সফর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও ক্ষত রয়ে যায় ঠিকই। ২০০৮ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে।
কিন্তু নিরাপত্তা শঙ্কায় বিভিন্ন দল উদ্বেগ জানাতে শুরু করলে একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের দলই পাঠাবে না জানিয়ে দেয়। টুর্নামেন্ট সরে যায় পাকিস্তান থেকে। তবে পাকিস্তান বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনে অলিখিত নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ২০০৯ সালে লাহোরের ঘটনায়।
সে বছরের মার্চে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের বাইরে শ্রীলঙ্কা দলের টিম বাসে সন্ত্রাসী হামলা হয়, যে হামলায় মারা যান ছয় পুলিশ সদস্য ও দুই পথচারী। এ ঘটনার পর কোনো দলই আর পাকিস্তানে যেতে রাজি হয়নি। ২০১১ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো ম্যাচ রাখা হয়নি।
লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলার পর পরবর্তী ছয় বছর আইসিসির কোনো পূর্ণ সদস্যদেশই আর পাকিস্তান সফরে যায়নি। চলতে থাকে অঘোষিত নির্বাসন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন থেকে পাকিস্তানের এই নির্বাসন কাটে ২০১৫ সালের মে মাসে জিম্বাবুয়ের সফরের মধ্য দিয়ে। অন্য দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সফর করতে শুরু করে ২০১৮ সাল থেকে।
এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে ঘরের মাটিতে পিএসএল আয়োজন করে আইসিসির কাছে টুর্নামেন্ট আয়োজনের অনুমতি চাইতে শুরু করে পিসিবি। ২০২১ সালের শেষ দিকে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজক স্বত্ব দেওয়া হয় পিসিবিকে, যা এখন ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে মাঠে গড়াতে চলেছে।
অবশ্য সব ম্যাচ পাচ্ছে না পাকিস্তান। অংশগ্রহণকারী সাত বিদেশি দলের ছয়টি পাকিস্তানে যেতে সম্মতি দিলেও ভারত রাজি হয়নি। এমনকি টুর্নামেন্টটি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ছিল বিসিসিআইয়ের। এ নিয়ে প্রায় দুই মাস টানাটানি চলেছে পিসিবি, আইসিসি ও বিসিসিআইয়ের মধ্যে।
শেষ পর্যন্ত ভারতের সব ম্যাচ দুবাইয়ে হবে সিদ্ধান্তে অচলাবস্থা কেটেছে। তবে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় পুরোপুরি উবেছে, বলা যাবে না। ইসলামাবাদ-ভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (সিআইএসএস) হিসাব অনুসারে, ২০২৪ সালে পাকিস্তানে ৭০০ নিরাপত্তাকর্মী, ৯০০ সশস্ত্র ব্যক্তিসহ আড়াই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। যদিও এর বেশির ভাগই উত্তর-পশ্চিমের খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেলুচিস্তান প্রদেশে।
অবশ্য পাকিস্তানে ভারতের না যেতে চাওয়ার পেছনে নিরাপত্তার চেয়ে ভূরাজনীতির প্রভাবই বেশি দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
ইএসপিএনক্রিকইনফোর লেখক ও ক্রিকেট বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু ফিদেল ফার্নান্দো যেমন সরাসরিই বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেকগুলো দলই তো কোনো সমস্যা ছাড়া পাকিস্তানে সফর করেছে। এখানে ভারতের না যাওয়ার পেছনে নিরাপত্তা কোনো বিষয় নয়। এখানে ভূরাজনীতি ও এর প্রভাবই বেশি।
কেন ভূরাজনীতির প্রসঙ্গ আসছে, আল-জাজিরার কাছে সেটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ক্রিকেট ইন পাকিস্তান: নেশন, আইডেনটিটি অ্যান্ড পলিটিকস বইয়ের লেখক আলী খান, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার সম্ভবত পাকিস্তানকে সর্বক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
সম্ভাব্য এই বিচ্ছিন্ন হওয়া রোধ করতেই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে অতি আগ্রহী পাকিস্তান। তিন দশক বড় টুর্নামেন্ট না দেখা পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীদের একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট উপভোগের সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি তো আছেই, সঙ্গে গড়ে ১৫ ক্রিকেটার নিয়ে ছয়টি বিদেশি দলকে দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় আতিথেয়তা দেওয়ার মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনের বাইরের বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজনের উদাহরণও তৈরি করতে চায় পাকিস্তান। মনে রাখতে হবে, পিসিবি চেয়ারম্যানের পাশাপাশি মহসিন নাকভির আরেকটি পরিচয় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!
করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের টস তাই শুধু পাকিস্তানের জন্য আইসিসি টুর্নামেন্ট আয়োজন থেকে ২৯ বছরের বিরতিরই অবসান নয়, ভূরাজনীতির খেলায় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়াও।
আমারবাঙলা/এমআরইউ
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            